বিশ্ব আবার এক অস্থির ও জ্বলন্ত মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে — ইরান ও ইসরায়েলের সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ যেন একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধেরই পূর্বাভাস। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, উভয় পক্ষই ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে একে অপরের ভূখণ্ডে, বিশেষ করে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে। যুদ্ধক্ষেত্রে রক্ত ঝরছে, আর কূটনৈতিক অঙ্গনেও তীব্র টানাপোড়েন চলছে।
শনিবার, ইসরায়েল তাদের সামরিক শক্তি পুরোপুরি উন্মুক্ত করে হামলা চালায় ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র — ইসফাহান কমপ্লেক্সে। ইরানি এক সিনিয়র কর্মকর্তা সিএনএনকে জানান, এই হামলায় পারমাণবিক পদার্থ লিক হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও আশেপাশের বাসিন্দাদের দ্রুত এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এছাড়া কোম শহরের একটি আবাসিক ভবনে চালানো হামলায় মারা যান ২ জন এবং আহত হন ৪ জন। এমন সময়ে এই হামলা হয়, যখন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ঘোষণা দিয়েছিল যে তারা ইরানে নতুন করে অভিযান শুরু করেছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ নিশ্চিত করেছেন, এই হামলায় ইরানের একজন শীর্ষ সামরিক কমান্ডার সাঈদ ইজাদি নিহত হয়েছেন।
জবাবে ইরান রাতভর ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে থাকে ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরের দিকে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে হোলন শহরে, যেখানে একটি ভবনে আগুন ধরে যায়। আগুন লাগার পরই দ্রুত সেখানে পৌঁছায় ইসরায়েলের জাতীয় জরুরি পরিষেবা ও দমকল বাহিনী। এই ঘটনায় প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি, তবে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সারা শহরে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ইসফাহানে আবারও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে, যা এই সংঘাতকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে।
সংঘাতের এই রক্তাক্ত প্রেক্ষাপটে আলোচনার দরজা এখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। একজন ইরানি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি ইসরায়েলি নেতাদের বলতেন হামলা বন্ধ করতে, তাহলে একটি ফোনকলেই এই যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়া সম্ভব হতো।
তবে ট্রাম্প নিউ জার্সিতে সাংবাদিকদের কাছে বলেন, "যখন কেউ জয়লাভ করছে, তখন সেই মুহূর্তে থামার অনুরোধ করা কঠিন।" এই মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়, আলোচনার দরজায় তালা ঝুলছে, আর সেই ফাঁকে জ্বলছে মধ্যপ্রাচ্য।
শুক্রবার জেনেভায় এক বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন শীর্ষ কূটনীতিক ও ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইরানি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে আলোচনায় তেমন অগ্রগতি হয়নি। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন, "ইসরায়েলের হামলার মধ্যে থাকাকালে আমেরিকার সঙ্গে আলোচনায় যাওয়া সম্ভব নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও বিভ্রান্তি কম নয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প খোলাখুলিভাবে তার জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালককে ইরান সম্পর্কিত ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য দায়ী করেছেন। তার ভাষ্যমতে, তুলসি গ্যাবার্ডের বক্তব্য ছিল ভুল — যে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দিকে যাচ্ছে না। ট্রাম্প স্পষ্ট করে বলেন, "তাহলে গোয়েন্দারাই ভুল করেছে।
আজ শনিবার ইস্তানবুলে বসেছে ৫৭টি মুসলিম দেশের সমন্বয়ে গঠিত ওআইসি-র জরুরি বৈঠক। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি এতে অংশ নিচ্ছেন। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম জানায়, এই বৈঠকে মূলত ইসরায়েলের আগ্রাসন নিয়ে আলোচনা হবে এবং পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার কড়া প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।
সংবাদ সংস্থা তাসনিম জানিয়েছে, ইরান এই বৈঠকে একটি বিশেষ প্রস্তাব উপস্থাপন করতে যাচ্ছে যেখানে ইসরায়েলের সামরিক কার্যক্রমকে ‘আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন’ হিসেবে উল্লেখ করা হবে।
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও নূর সংবাদ সংস্থার সর্বশেষ তথ্যমতে, ১৩ জুন থেকে এই সংঘাত শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ইরানে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪৩০ জন। আহত হয়েছেন প্রায় ৩,৫০০ জনেরও বেশি। যাদের মধ্যে বহু মানুষ এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। স্কুল, হাসপাতাল, ধর্মীয় স্থাপনা — কোনো কিছুই হামলার বাইরে থাকছে না।
একটি মাত্র ফোনকলেই থেমে যেতে পারে এই ভয়ানক সংঘাত — অথচ সেই ফোনকল আসছে না। বরং ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, পারমাণবিক ভীতি আর মৃতদেহের স্তূপে গড়িয়ে পড়ছে মানবতা।
যুদ্ধ কি কেবল অস্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি আলোচনার পথে ফিরে আসবে বিশ্ব?
এই উত্তর এখন সময়ই দেবে। তবে যতক্ষণ না সেই আলোচনার আলো দেখা যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিশ্ব কাঁপছে যুদ্ধের পদধ্বনিতে।