২২ এপ্রিল ২০২৫, জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার পাহেলগাঁও এলাকার বৈসারণ উপত্যকায় সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা ভারতের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের একটি জটিল ও গভীর প্রতিচ্ছবি। এই হামলাকে শুধুমাত্র বিচ্ছিন্ন কোনো সন্ত্রাসী তৎপরতা হিসেবে দেখা যাবে না; বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের অংশ, যার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর নির্দয় আঘাত হানা এবং ভারতের সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে আরও উসকে দেয়া। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই হামলা মোদি সরকারের দীর্ঘমেয়াদী মুসলিম নিধন নীতির একটি অংশমাত্র।
ঘটনার পটভূমিতে গেলে দেখা যায়, হামলার মাত্র দুইদিন আগে থেকেই এলাকায় অস্বাভাবিক তৎপরতা শুরু হয়েছিল। ইন্ডিয়ান রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (RAW) সংস্থার এজেন্টদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর আনুষ্ঠানিক চেকপোস্টগুলো ক্রমাগত সরিয়ে ফেলা হয়। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কোনো সংবেদনশীল এলাকায় এই ধরনের নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা হয় না, বিশেষ করে যখন গোয়েন্দা তথ্য আগাম সতর্কবার্তা দেয়। অথচ এই ক্ষেত্রে চূড়ান্ত উদাসীনতা ও শৈথিল্যের পরিচয় দেয়া হয়, যা হামলার পূর্ব পরিকল্পনার সন্দেহকে আরও দৃঢ় করে।
সরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থার এই শিথিলতাকে কেন্দ্র করে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। চেকপোস্ট অপসারণ, সেনা প্রত্যাহার এবং গোয়েন্দা তথ্যের প্রতি ইচ্ছাকৃত অবহেলা সবকিছু মিলে একটি গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মোদি সরকারের উচ্চপর্যায়ে এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছিল এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে বাধ্য করা হয়েছিল নির্দিষ্ট এলাকা ছেড়ে চলে যেতে। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরাও মুখ খুলেছেন এবং জানিয়েছেন, তাদের ওপর উচ্চচাপ প্রয়োগ করে নিরাপত্তাবিহীন এলাকা ছাড়তে বলা হয়েছিল।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বিজেপির শীর্ষ নেতারা হামলার আগে থেকেই ধারাবাহিকভাবে মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছিলেন। বিভিন্ন সভা, সমাবেশ এবং মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে দিয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে একপ্রকার নিশানা বানানো হচ্ছিল। হিন্দুত্ববাদী আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা উস্কে দেয়ার প্রবণতা ছিল সুস্পষ্ট। এর ফলে জনমনে মুসলিমবিরোধী মনোভাব আরও দৃঢ়তর হয়, যা সহিংসতার সামাজিক ভূমি প্রস্তুত করে।
হামলার আগের দিন পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক প্রচারণা চালানো হয়। লক্ষ্য ছিল, হামলার পর পাকিস্তানকে দোষী সাব্যস্ত করে আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন করা। হামলার পরপরই ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ইন্দাস পানি চুক্তি স্থগিত করা হয়, সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। এই ঘটনাপ্রবাহকে বিশ্লেষকরা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা থেকে দৃষ্টি সরানোর কৌশল বলেই মনে করছেন।
এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরব হয়। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএমসহ একাধিক দল সরাসরি মোদি সরকারকে দায়ী করে। রাহুল গান্ধী বলেন, "এই হামলার জন্য দায়ী সরকার নিজেই।" মমতা ব্যানার্জি প্রশ্ন তোলেন, "কেন সেনা প্রত্যাহার করা হলো তার কোনো ব্যাখ্যা এখনো দেয়া হয়নি।" বামপন্থী দলগুলো এই ঘটনাকে পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে অভিহিত করেছে এবং স্বাধীন তদন্তের দাবি তুলেছে।
সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়াও ছিল তীব্র। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মন্তব্যগুলোতে মোদি সরকারের প্রতি প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, যারা নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বে ছিল তারাই কেন নিরাপত্তা তুলে নিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের পথ সুগম করলো? বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছে। এদের মতে, দেশের সংবিধানিক কাঠামো এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি আজ চরমভাবে বিপন্ন।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াও দ্রুত আসে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ওআইসি উদ্বেগ প্রকাশ করে। বিশেষ করে ওআইসি তাদের বিবৃতিতে বলে, "কাশ্মীরের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানবাধিকার লঙ্ঘন এখন বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।" আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, ভারতের এই মুসলিম নিধন নীতি দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তা আজ ভারতে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থানের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে।
এই হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মোদি সরকারের অতীত কর্মকাণ্ড এর স্পষ্ট প্রমাণ দেয়। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পটভূমি থেকে শুরু করে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা, এরপর এনআরসি ও সিএএ আইন প্রবর্তন—সবকিছু মিলিয়ে একটি ধারাবাহিক মুসলিম নিধন নীতি পরিলক্ষিত হয়। অনন্তনাগ হামলা সেই একই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত, যেখানে মুসলিমদের নিরাপত্তা ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বল করে তাদের নিশানা বানানো হয়েছে।
উপসংহারে বলা যায়, সেনা প্রত্যাহার, গোয়েন্দা তথ্যের অবজ্ঞা, মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য, সীমান্তরক্ষীদের স্বীকারোক্তি, বিরোধী দলগুলোর সরাসরি অভিযোগ এবং আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সব মিলিয়ে অনন্তনাগ হামলার নেপথ্যে এক গভীর ষড়যন্ত্রের ছায়া স্পষ্ট। এই হামলা ভারতের গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে শুধু আঘাতই করেনি, বরং তা আন্তর্জাতিক স্তরেও ভারতের ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
এই অবস্থায় আমাদের জোরালোভাবে দাবি করা উচিত, অনন্তনাগ হামলার পুঙ্খানুপুঙ্খ, স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিক মানের নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। যারা এ ধরনের গণহত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোরতম শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এবং সংবিধানিক ন্যায়বিচার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তৎপর হতে হবে সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে। নতুবা ভবিষ্যতে এমন আরও ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা থেকেই যাবে, এবং ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্র চিরতরে বিপন্ন হয়ে পড়বে।