মুসলিম যুবক নিউইয়র্ক মেয়র, জায়নিস্টদের পরাজয়ে আমেরিকা কি গৃহযুদ্ধের পথে?..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
মামদানি'র এই বিজয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'মেগা' (MAGA) এবং ভয়-ভিত্তিক রাজনীতির কৌশলকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন মামদানিকে 'কমিউনিস্ট' এবং 'বিপজ্জনক'..

নিউইয়র্ক সিটি রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা হলো। মাত্র ৩৪ বছর বয়সী ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম নেতা জোহ্রান মামদানি, নিউইয়র্কের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হয়ে এক নতুন ইতিহাস গড়লেন। একজন ডেমোক্রেটিক সমাজবাদী (Democratic Socialist) হিসেবে তাঁর এই জয় কেবল স্থানীয় নির্বাচন নয়, বরং ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী পরিচালিত ডানপন্থী, ইসলামোফোবিক এবং কর্পোরেট-কেন্দ্রিক রাজনীতির জন্য এক কঠিন আদর্শিক ও কৌশলগত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।

মামদানি তাঁর বিজয়ের পর দেওয়া প্রথম বক্তৃতায় ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর ঐতিহাসিক 'নিয়তির সঙ্গে অভিসার' (Tryst with Destiny) বক্তৃতার কালজয়ী অংশ উদ্ধৃত করেন। তিনি বলেন:

“ইতিহাসে খুব কম এমন মুহূর্ত আসে, যখন আমরা পুরাতন থেকে বের হয়ে নূতনের মধ্যে প্রবেশ করি, যখন একটি যুগের সমাপ্তি ঘটে, এবং জাতির আত্মা, যা দীর্ঘকাল ধরে দমন করা হয়েছিল, তার কণ্ঠ খুঁজে পায়।"

এই বক্তব্যটি ভারতে নেহরু-বিরোধী প্রচারণার মুখে এক শক্তিশালী আদর্শিক জবাব হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং বিশ্বকে এই বার্তা দিচ্ছে যে, বহুসাংস্কৃতিক পরিচিতি নিয়েও জনকল্যাণমূলক প্রগতিশীল রাজনীতি সফল হতে পারে।

মামদানি'র নির্বাচনী প্রচারণার মূল ভিত্তি ছিল সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সংগ্রাম। তিনি সরাসরি ওয়াল স্ট্রিট-এর কোটিপতি, ক্রনি ক্যাপিটালিস্ট এবং কর্পোরেট পুঁজির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর মূল প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল ধনীদের ওপর কর বাড়িয়ে সেই অর্থ দিয়ে সাধারণের জন্য সাশ্রয়ী আবাসন (Affordable Housing), বিনামূল্যে বাস পরিষেবা (Free Buses) এবং সার্বজনীন শিশু পরিচর্যা (Universal Child Care) নিশ্চিত করা। এই জমিনি ইস্যু-ভিত্তিক রাজনীতি প্রমাণ করে যে, সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা নিয়ে আলোচনা করলে বিপুল জনসমর্থন অর্জন করা সম্ভব।

মামদানি'র এই বিজয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'মেগা' (MAGA) এবং ভয়-ভিত্তিক রাজনীতির কৌশলকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন মামদানিকে 'কমিউনিস্ট' এবং 'বিপজ্জনক' বলে চিহ্নিত করে ফেডারেল ফান্ডিং কেটে দেওয়ার হুমকি দিলেও, নিউইয়র্কের মধ্যবিত্ত ও তরুণ প্রজন্ম এই বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মামদানি'র জয়কে জায়নবাদের কফিনে শেষ পেরেক হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। নিউইয়র্কের মতো একটি জায়নবাদী (Zionism) এবং হাইপার-ক্যাপিটালিজমের কেন্দ্রে একজন মুসলিম সমাজবাদীর জয় স্পষ্ট করে দেয় যে, আমেরিকার মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখন আর 'ইসরায়েল ফার্স্ট' নীতিকে সমর্থন করছে না। মামদানি'র সরকার এখন অভিবাসী অধিকার (Immigration Rights) এবং Sanctuary Policies শক্তিশালী করবে, যা ট্রাম্প প্রশাসনের ICE অভিযান এবং ডিপোর্টেশন ড্রাইভের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করবে।

মামদানি কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন। তিনি প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সামরিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে নিউইয়র্কে প্রবেশ করলে গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়েছিলেন।

এই নির্বাচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো সোশ্যাল মিডিয়া এবং কমিউনিটি ক্যাম্পেইনের শক্তি। মামদানি'র সাফল্য ঐতিহ্যবাহী গণমাধ্যম বা অভিজাতদের সমর্থন ছাড়াই অর্জিত হয়েছে। এই ঘটনা বিশ্বজুড়ে মুসলিম রাজনীতিকে একটি মডেল দিয়েছে যে, ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিজস্ব বয়ান তৈরি করা সম্ভব এবং তা রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে সমালোচকরা সতর্ক করেছেন যে, মামদানি'র এই বিজয় আমেরিকাকে গৃহযুদ্ধের (Civil War) দিকে ঠেলে দিতে পারে। মামদানি যে অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস সহজে বাস্তবায়ন করতে দেবে না। এর ফলে প্রেসিডেন্ট (এলিটদের প্রতিনিধি) বনাম মেয়র (মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি)-এর মধ্যে তীব্র শ্রেণী সংঘাত তৈরি হবে, যা রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াবে।

তা সত্ত্বেও, মামদানি'র বিজয় একটি বৃহত্তর বার্তা বহন করে: এটি প্রমাণ করে যে, মুসলিম পরিচয় নিয়েও মূলধারার রাজনীতিতে এসে যুদ্ধবিরোধী, বৈষম্যহীন এবং জনমুখী নীতি নিয়ে সফল হওয়া সম্ভব। তাঁর এই জয় বিশ্বজুড়ে রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তনের এক নতুন অধ্যায় সূচনা করলো।

Hiçbir yorum bulunamadı


News Card Generator