মোমবাতির আলোয় বিরোধীদের বিচার: সাবেক আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ আদালতে
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের রাতের আঁধারে বিচার করে সাজা দেওয়া হতো বলে অভিযোগ তুলেছেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী। বুধবার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এক শুনানিতে তিনি এই বিস্ফোরক মন্তব্য করেন।
শুনানির সময় পিপি ফারুকী বলেন, "তখনকার আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের আমলে রাত দশটায় এই আদালতে বিচার বসত। মোমবাতি জ্বালিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিচার চলত এবং নির্বিচারে সাজা দেওয়া হতো।" তাঁর এই বক্তব্যের সময় আনিসুল হক কাঠগড়ায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং আদালতে কোনো মন্তব্য করেননি। এমনকি তাঁর আইনজীবীও ছিলেন নীরব।
বুধবার আদালতে হাজির করা হয় আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতাকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আমির হোসেন আমু, আনিসুল হক, শাজাহান খান, প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, এবং সাবেক সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল হক। একইসঙ্গে আদালতে হাজির করা হয় সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননকেও।
জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে বংশাল থানার একটি হত্যা মামলায় দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। আদালতে জাহাঙ্গীরের আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিন বলেন, তাঁর মক্কেল অসুস্থ ও সরকারি আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু পিপি ওমর ফারুকের দাবি, "জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন ফ্যাসিস্ট হাসিনার সহযোগী। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমন, পুলিশি ষড়যন্ত্র, সব কিছুর সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল।"
তিনি আরও বলেন, "এই সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তাদের সঙ্গে মিটিং করতেন, পরিকল্পনা করতেন—কে কোথায় কীভাবে দমন করতে হবে।"
আদালতে আরও জানানো হয়, আওয়ামী লীগের সময় যেসব বিচারক নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রভাব ছিল। "জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে বিচারকদের ডিএনএ টেস্ট পর্যন্ত করেছে সরকার। গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ, স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনুমোদন—সব মিলিয়ে বিচারকদের বাছাই করা হতো," অভিযোগ করেন ওমর ফারুক।
তিনি অভিযোগ করেন, প্রশাসন ও পুলিশেও ছিল একই চিত্র। ভিন্নমতাবলম্বীদের ওএসডি করা হতো, কেউ চাকরি হারাতেন, আবার কাউকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের অনুগতদেরই প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হতো বলে দাবি করেন তিনি।
আদালতের কঠোর নিরাপত্তা, নেতাদের বিমর্ষ উপস্থিতি
সকাল দশটার পর আদালতের হাজতখানা থেকে হাতকড়া পরা অবস্থায় একে একে আনা হয় সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের। আনিসুল হকের দুই হাত পিছনে হাতকড়া পরা ছিল, তবে আদালতকক্ষে এনে এক হাতের হাতকড়া খোলা হয়। শুনানিতে যাত্রাবাড়ী থানার তিনটি হত্যা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করে পুলিশ।
রাশেদ খান মেনন আদালতে একটি ওষুধ চেয়ে আবেদন করেন। তাঁর আইনজীবী আদালতকে জানান, ওষুধ ফার্মেসি থেকে কিনে আনা হয়েছে। তবে বিচারক জানান, কেবল কারা কর্তৃপক্ষই ওষুধ দিতে পারবে। পরে আদালতের হাজতখানা কর্মকর্তাকে বিষয়টি তদারকি করতে বলেন তিনি।
শাজাহান খান আদালতে বলেন, "আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারছেন না। অনুগ্রহ করে তাঁকে বসার অনুমতি দেওয়া হোক।" আদালত কর্মচারীদের একটি টুল এনে বসার ব্যবস্থা করতে বলেন। এরপর আমু বসতে পারেন।
সাবেকদের আদালত থেকে ফেরত পাঠানো, মুখে বিষণ্নতা
শুনানি শেষে আমির হোসেন আমু, শাজাহান খান, জুনায়েদ আহমেদ পলকসহ অন্যদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাঁদের আবার হাজতখানায় পাঠানো হয়। প্রত্যেকের মুখে ছিল উদ্বেগ ও চাপা উত্তেজনা। আদালতে ঢোকা ও বের হওয়ার সময়ও তাদের মুখে কোনো মন্তব্য ছিল না। চারপাশের কঠোর নিরাপত্তা ও মিডিয়ার ভিড়ে তাঁদের চেহারায় ফুটে উঠেছিল চাপা অসহায়ত্ব।



















