রাজধানীর সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে দায়ের হওয়া একাধিক হত্যা মামলায় বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এই মামলাগুলোর অন্যতম প্রধান আসামি হিসেবে এবার গ্রেফতার দেখানো হলো সাবেক সংসদ সদস্য এবং জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলম, এবং নোয়াখালীর সাবেক পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান–এ চার প্রভাবশালী ব্যক্তিকে।
আজ সোমবার (১৯ জুন), ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পার্থ ভদ্রের আদালতে পুলিশ তাদের পৃথক তিনটি মামলায় গ্রেফতার দেখানোর আবেদন করে। শুনানি শেষে আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেন। অভিযুক্তদের বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে।
তিনটি ভিন্ন ভিন্ন থানার তিনটি হত্যা মামলায় অভিযুক্ত এই চার ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট আদালত গ্রেফতার হিসেবে গণ্য করেছে।
১. ধানমন্ডি থানার কিশোর শামীম হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত হন জাহাঙ্গীর আলম ও শাহে আলম মুরাদ।
২. কোতয়ালী থানার শাওন মুফতি হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হন মমতাজ বেগম।
৩. যাত্রাবাড়ী থানার মঈনুল ইসলাম হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হন মো. আসাদুজ্জামান।
এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে মমতাজ বেগমের নাম। তিনি মানিকগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, সাংস্কৃতিক অঙ্গনেরও পরিচিত মুখ। রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ও সুনাম থাকা সত্ত্বেও এবার তাকে খুনের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলো, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে.
শাওন মুফতি নামের ২৩ বছরের এক শিক্ষার্থী গত ৫ আগস্ট রাজধানীর কোতয়ালী থানাধীন তাঁতীবাজার মোড়ে "বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে" অংশ নিয়েছিলেন। সেদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা যায়, আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে আসা একদল অস্ত্রধারী সাদা পোশাকধারী ব্যক্তি গুলি চালালে শাওন গুলিবিদ্ধ হন। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলেও রাত দেড়টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
এই ঘটনায় নিহত শাওনের মা মাকসুদা বেগম গত ২৮ মে কোতয়ালী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতাসহ মোট ৫৭ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এজাহারে মমতাজ বেগমকে ১৪ নম্বর আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এই গ্রেফতারগুলোর ফলে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একদিকে ছাত্র আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ এবং অন্যদিকে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সংঘটিত সহিংসতার দায়ভার এখন প্রভাবশালী নেতাদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ছে। আইনজীবীদের মতে, যদি এই মামলাগুলোতে বিচারিক তদন্ত নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়, তবে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটতে পারে।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, তারা ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি, ফরেনসিক রিপোর্ট এবং ঘটনার সময়কার মোবাইল টাওয়ার লোকেশন বিশ্লেষণ করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছেন। যদিও গ্রেফতার হওয়া কেউই এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও বক্তব্য দেননি, তবে একাধিক আসামির আইনজীবী দাবি করেছেন, মামলাগুলো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ।
বর্তমানে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের রিমান্ডে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ। সেইসঙ্গে এই মামলাগুলোর তদন্তকে আরও বিস্তৃত করা হচ্ছে। মামলার অন্যান্য অভিযুক্তদের নামেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে তদন্ত সংস্থা।
ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জন্ম নেওয়া এই মামলা এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। গ্রেফতার হওয়া প্রভাবশালী নেতাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে। এই মামলাগুলোর রায় নির্ধারণ করবে – আইনের শাসন কতটা বাস্তব, আর রাজনৈতিক প্রভাব কতটা মুখ্য।