সারা দেশের ২৫% ডেঙ্গু রোগীর দায়িত্ব মাত্র ১০ জন চিকিৎসকের কাঁধে, বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে এই মুহূর্তের অবস্থা ভয়াবহ।
বরগুনার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল সূত্র থেকে জানা যায়, সারা দেশে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী প্রায় পাঁচ হাজার জন। এরমধ্যে বরগুনায় আক্রান্ত ১২০০+ (প্রায় ২৫%) অথচ ২০২৪ সালের জানুয়ারি-মে মাসে আক্রান্ত ছিল মাত্র ১৮০ জন। যা এক বছরে আক্রান্তের হার বেড়েছে প্রায় ৭ গুণ।
এছাড়া প্রতিদিন গড়ে অন্যান্য রেগী সহ মোট ৫০০+ রোগী ভর্তি থাকে, আউটডোরে চিকিৎসা নেয় প্রায় ১০০০ রোগী। হাসপাতালটি ২৫০ শয্যা হওয়ায় এখানে ২৫০ জন ভর্তি রোগী খাবার পায়, বিধায় ২৫০ + ভর্তি রোগী খাবার পায় না। ঔষধ সামগ্রী থাকে ২৫০ জন রোগীদের জন্য, যা সব রোগীকে দেয়া সম্ভব হয় না, তাই সবাই পর্যাপ্ত ঔষধ পায় না।
এ বিপুলসংখ্যক রোগীর চিকিৎসায় আছেন মাত্র ১০ জন চিকিৎসক। এদের মধ্যে জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন) ১ জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু) ১ জন, আবাসিক চিকিৎসক (ভারপ্রাপ্ত) ১ জন, মেডিকেল অফিসার (জরুরি বিভাগ, অন্তঃবিভাগ আউটডোর) ৭ জন। চিকিৎসকরা এ সকল রোগীদের চিকিৎসা-সেবা দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। তারা দিনরাত ঘুমহীন থেকে, হাসপাতালের সীমিত সম্পদে, অক্লান্তভাবে ডেঙ্গু ও অন্যান্য রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত।
বরগুনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এ পর্যন্ত জেলার ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। সম্প্রতি মৃত্যু হয় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি থাকা আজমেরী মোনালিসা জেরিন নামে এক নারী উদ্যোক্তার। তিনি বরগুনা ১ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য জাফরুল হাসান ফরহাদের কন্যা। যিনি ঈদুল আজহার আগের রাতে নিজের জন্মদিনেই মৃত্যুবরণ করেন এবং পরেরদিনই ঈদুল আজহা ও তার নিজের বিবাহ বার্ষিকীতেই দাফন হয়। যা বরগুনার মানুষদের ব্যথিত করেছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে গিয়ে রোগীরা যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে অসহায় অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। রোগী ও তাদের স্বজনদের অনেকেই বলছেন, হাসপাতালে গিয়ে মানুষ শুধু রোগ বাড়িয়ে নিয়ে আসছে। যে যেখানে থাকে সেখানেই মশার কামড় খাচ্ছে। এতে জনসাধারণের মাঝে আতঙ্ক ও উদ্বেগের সৃষ্টি করছে।
বরগুনা পৌরসভা ও গৌরিচন্নায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। এসকল এলাকার বিভিন্ন যায়গায় জমে থাকা নোংরা পানি, ময়লার স্তূপ ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মশার উপদ্রব বাড়ছে। বিশেষ করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল ও আশপাশ এলাকার এমন পরিবেশ সেখানে ডেঙ্গু আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। হাসপাতালের পাশে গণপূর্ত বিভাগের পরিত্যক্ত জমি দখল করে ডোবার ওপর গড়ে ওঠা অবৈধ দোকান ও স্থাপনার নিচে রয়েছে ডেঙ্গুর প্রজননস্থল।
বেশ কিছুদিন আগে মৃত্যুবরন করেছে বরগুনা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য নজরুল ইসলাম মোল্লার ১৯ বছর বয়সি কন্যা উপমা।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মেয়ের মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল ইসলাম মোল্লা বরগুনা পৌরসভার প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে মেয়ের জানাজা শেষে তিনি বলেন, বরগুনা পৌরসভা আজ দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে টাকা নেওয়া ছাড়া এখানে কোনো সেবাই পাওয়া যায় না। দেশের কোথাও এত ডেঙ্গুর প্রকোপ নেই, যতটা বরগুনায়। আমি বারবার পৌর প্রশাসককে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছিলাম, কিন্তু কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। একজন স্কুল প্রধান শিক্ষিকা ডেঙ্গুতে মারা গেলেন। আমার মেয়েও চলে গেল। আমি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আর কোনো বাবাকে যেন সন্তানের মৃত্যু দেখতে না হয়। যদি সেবা দিতে না পারে, তাহলে এমন প্রতিষ্ঠান আমাদের দরকার নেই- আমরা তা বন্ধ করে দেব।"
বরগুনা পৌর এলাকায় নিয়মিত মশা নিধনের ফগিং কার্যক্রম না থাকায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। স্থানীয় একজন গৃহিণী সানজিদা জূথি জানান, "শুধু নামমাত্র কিছু ওয়ার্ডে ফগিং হয়। অথচ শহরের ৮০ ভাগ এলাকায় আজও ধোঁয়ার মুখ দেখিনি।"
ঈদের ছুটি কাটাতে বরগুনা এসে অনেকেই আতঙ্কে আছেন, পৌর এলাকার ৩ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবদুর রহমান মো. তানভীর বলেন : আমিসহ আমার পরিবারের সবাই ডেঙ্গু আতঙ্কে আছি। আর সাদিকুল ইসলাম নামের একজন বাসিন্দা জানান, আমার পরিবার এবার ঈদের আনন্দ করতে ডেঙ্গু সচেতনতার জন্য বরগুনা আসেনি। ফলে আমাকে একাই ঈদ উৎযাপন করতে হয়েছে।
বরগুনার এমন ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসনের দিক থেকে দ্রুত ও কার্যকর উদ্যোগ না নিলে এই শান্ত শহর ভয়াবহ সংকটে পড়তে পারে। তাই সময় থাকতে দৃষ্টি দিতে হবে, অন্যথায় ডেঙ্গু হবে এখানকার মানুষের জীবনের দুঃস্বপ্ন।