২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ভয়াবহতম সহিংসতার বিচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। রবিবার সকালে, শেখ হাসিনাসহ তিন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানির সূচনায় এক আবেগঘন বক্তব্য দেন প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “আজ ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্তে এই পবিত্র কক্ষে দাঁড়িয়ে আমি শুধু একজন আইনজীবী নই, আমি ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের শ্রদ্ধাভাজন ভাষ্যকার।”
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষের ওপর যে নিপীড়ন চালানো হয়েছিল, সেটিকে “নারকীয় বীভৎসতা” হিসেবে বর্ণনা করে তাজুল ইসলাম বলেন, “ক্ষমতা ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টায় রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের অপব্যবহার করে যে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতা চালানো হয়েছিল, তাতে পুরো দেশই এক বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল।”
তিনি জানান, এই বিচার শুধুমাত্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনও রাজনৈতিক প্রতিশোধ নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে ‘রোম স্ট্যাটিউট’, আইসিসি নীতিমালা এবং বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের আওতায় একটি জবাবদিহিমূলক প্রক্রিয়া।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “২০২৪ সালের বর্ষাকালে যা ঘটেছিল, তা কেবল জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত, সংগঠিত ও রাষ্ট্রীয় সমর্থনে পরিচালিত সহিংস অভিযান।”
তিনি আরও বলেন, “নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা, নারী ও শিশু যারা বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল, তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা, নির্যাতন, গুম ও অঙ্গহানি করা হয়। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা পেতে বাধা দেওয়া হয়, এমনকি জীবিত ও মৃতদের একত্রে পুড়িয়ে ফেলার মত বর্বর কাজও সংঘটিত হয়।”
চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হবে—প্রত্যক্ষদর্শী ও ভিকটিমদের সাক্ষ্য, ভিডিও ফুটেজ, সিসিটিভি ও ড্রোন ফুটেজ, টেলিফোন আলাপের অডিও ক্লিপস, ফরেন্সিক রিপোর্ট, এবং অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি।
তিনি বলেন, “এই বিচার প্রমাণ করবে যে কোনো সভ্য সমাজে, যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন বিদ্যমান, সেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না।”
‘মনসুন রেভুলেশন’ বা বর্ষা বিপ্লব নামে পরিচিত সেই আন্দোলন ছিল একটি প্রজন্মের আত্মদানের প্রতীক—এমনটাই উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, “এই বিচার শুধু অতীতের প্রতিশোধ নয়—এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা।”
তিনি বলেন, “আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সেই সব মানুষদের, যারা ফিরে আসেননি। যারা চোখ, হাত, পা হারিয়েছেন, কিংবা আর কোনোদিন স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি। সেই সাহসী তরুণদের ত্যাগেই আজ বাংলাদেশ নতুন এক স্বপ্নের সন্ধানে এগিয়ে চলছে।”
চিফ প্রসিকিউটর তার বক্তব্যের শেষাংশে বলেন, “এই আদালত ইতিহাসের এক প্রামাণ্য দলিল হয়ে থাকবে। আমরা চাই, এ বিচার হোক নিরপেক্ষ, প্রমাণনির্ভর এবং ন্যায়ভিত্তিক—যাতে এই জাতি সত্যিকার অর্থেই পুনর্জাগরণ ঘটাতে পারে।”