যশোর কালেক্টরেট ভবনে অপ্রীতিকর কাণ্ড

সুভাষ মজুমদার avatar   
সুভাষ মজুমদার
দুই জন স্টাফ আহত, কথিত প্রতিবন্ধী লাঞ্ছিত, ৫ শিক্ষার্থী অবরুদ্ধ

তুচ্ছ ঘটনায় যশোর কালেক্টরেট ভবনে যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের বারান্দায় অপ্রীতিকর কান্ড ঘটেছে। গণ শুনানীতে আসা কথিত এক প্রতিবন্ধীর সাথে বাকবিতন্ডা ও পরে হাতাহাতি, এমনকি ক্রাচ দিয়ে ডিসি অফিসের এক স্টাফকে আঘাত করার ঘটনা ঘটেছে। পরে এ ঘটনাকে ইস্যু করে স্কুল কলেজ পালানো কয়েক শিক্ষার্থী কালেক্টরেট ভবনে চড়াও হয়ে ফের বাকবিতণ্ডা ও ভাংচুরের চেষ্টা করে। এসময় তাদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখেন ডিসি অফিসের স্টাফরা।
পরে জেলা প্রশাসকের মধ্যস্থতায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান ও অভিভাবকদের কাছে শিক্ষার্থীদের হস্তান্তর করা হয়।


এদিকে স্কুল কলেজ চলাকালীন পোষাক পরা অবস্থায় ওই ছাত্ররা কালেক্টরেট ভবনে আসল কিভাবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম। তিনি সংশ্লিষ্ট ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
আবার বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে বলা হচ্ছে ডিসি অফিসে গিয়ে একজন প্রতিবন্ধী কেনো কাঁদতে কাঁদতে নিচে নামবে এরও উত্তর খুঁজতে হবে।
কালেক্টরেট ভবনের ওই ঘটনায় তুমুল হৈচৈ চলে গোটা যশোর শহরব্যাপী।


প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও জেলা প্রশাসন সূত্র থেকে তথ্য মিলেছে, ২১ মে বুধবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গণশুনানীর দিন ছিল। প্রতি রোববার তৃনমূলসহ সব মহলের মানুষের নানাবিধ অভিযোগ অনুযোগ দাবি দাওয়া নিয়ে গণশুনানী হওয়ায় ভীড় থাকে। দুশো থেকে ৩শ’ জনের মত মানুষকে ফেইস করতে হয় ডিসিসহ সংশ্লিষ্টদের। আর এদিন দুপুর সোয়া একটার দিকে যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ইউনিয়ন থেকে ৪৫ বছর বয়সী মনিরুল ইসলাম নামে এক প্রতিবন্ধী ক্রাচ হাতে আসেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কক্ষের সামনে। তিনি জেলা প্রশাসকের সাথে দেখা করতে চান। কিন্তু প্রতি বুধবারে ওই একই ব্যক্তি বার বার আসায় বাধ সাধেন কয়েক স্টাফ। এরপর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের অফিস সহকারীর কক্ষে এসে তাকে প্রতিবন্ধী কার্ড দেয়ার দাবি জানান। তখন অফিস সহকারী জানান, এখানে কার্ড দেয়া হয় না, ইউনিয়ন পরিষদে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি। একপর্যায়ে প্রতিবন্ধী ওই ব্যক্তি গালিগালাজ শুরু করেন। তখন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের অফিস সহকারী বাবুল আক্তার ও আবু হাসান তাকে নিষেধ করলে দু’পক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে ওই প্রতিবন্ধী হাতে থাকা ক্রাচ দিয়ে অফিস সহকারী বাবুল আক্তারের মাথায় আঘাত করেন। আরেক অফিস সহকারী আবু হাসান এগিয়ে আসলে তার হাতে কামড় দেন ওই প্রতিবন্ধী। পরে অন্য কর্মচারীরা এসে ওই প্রতিবন্ধীকে ধাক্কাধাক্কি করে নিচে নামিয়ে দেন। এসময় কাঁদতে কাঁদতে সিড়ি দিয়ে নেমে আসেন তিনি।


প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই প্রতিবন্ধীর কান্না দেখে ডিসি অফিস চত্ত্বরে অবস্থান করা শহরের মুসলিম একাডেমি, জিলা স্কুল ও যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের ৫ শিক্ষার্থী ঘটনা জানতে কালেক্টরেট ভবনের দ্বিতীয় তলায় যায়। বিষয়টি শিক্ষার্থীরা মিমাংসা করতে এসে প্রতিবন্ধীর পক্ষ নিয়ে ডিসি অফিসে চড়াও হয়ে যথেচ্ছা করার চেষ্টা চালায়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মচারীদের সাথে তারা বাকবিতণ্ডা করে। এরপর কয়েকজন বাঁশ দিয়ে জেলা প্রশাসকের নেজারত শাখায় হামলা করে এবং ভাংচুর করার চেষ্টা করে। পরে কর্মচারীরা পাঁচজনকে নেজারত শাখায় আটকে রাখেন। এরপর যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম, পুলিশ ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী, সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং অভিভাবকগণের সমন্বয়ে ঘটনার মিমাংসা হয়। জেলা প্রশাসক নানা দিক নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়ে ছাত্রদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের জিম্মায় দেন।
ঘটনার ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের আহত অফিস সহকারী আবু হাসান জানিয়েছেন, প্রতিবন্ধী লোকটি এসেছিল কার্ডের জন্য। তাকে বুঝানো হলেও চিৎকার করে গালিগালাজ করতে শুরু করেন। তাকে বলা হয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্যারেরা আছেন চুপ করেন। এরপরও গালিগালাজ দিতে থাকেন। তার কাছে গেলে সহকর্মী বাবুল আক্তারের মাথায় আঘাত করেন। ঠেকাতে গেলে তাকেও মারধর শুরু করেন। শেষে কামড় দেন হাতে। পরে অন্য সহকর্মীরা তাকে নিচে নামিয়ে দেন। তারা প্রতিবন্ধীকে মারধর করেননি বলে দাবি করেন। এরপর শিক্ষার্থীরা তাদের উপর হামলা চালায়। শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের গোলযোগের এক ফাঁকে প্রতিবন্ধী ওই ব্যক্তি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্ত্বর ত্যাগ করেন।
নেজারত শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা শাহিদুজ্জামান জানিয়েছেন, ১০/১৫ জনের শিক্ষার্থী দল তার কক্ষে হামলা চালায়। তাদের মধ্যে একজনের হাতে বাঁশ ছিল। সে কক্ষের দরজা ও জানালায় বাড়ি মারে। এগুলো বৃটিশ আমলের রড দিয়ে বানানো, তাই দৃশ্যত ক্ষত হয়নি। এমনকি তারা কক্ষে এসেও কয়েকজনের উপর হামলা চালায়। পাঁচ জনকে অবরুদ্ধ করা হলেও বাকিরা পালিয়ে যায়।
এদিকে অবরুদ্ধ হওয়া পাঁচ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তারা ডিসি অফিস চত্ত্বরে বসেছিল। এসময় দেখে অসহায় প্রতিবন্ধী একটা মানুষকে মারধর করছে কিছু লোক। এসে শোনে তারা জেলা প্রশাসনের কর্মচারী। তাই প্রতিবাদ জানিয়েছি মাত্র। প্রতিবন্ধীর দোষ ছিল কিনা সেটা জানি না। তবে হামলা করা ভুল হয়েছে বলে তারা গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করে।
যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক কাজী বাবুল হোসেন জানিয়েছেন, অবরুদ্ধ থাকা পাঁচ শিক্ষার্থী নিয়ে জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম স্যারের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিকেল ৪ টার দিকে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের মুচলেকা নিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে ঘটনার ব্যাপারে যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম জানিয়েছেন, প্রতিবন্ধী দাবি করা লোকটি প্রায় প্রতি বুধবারেই শুনানীতে আসেন। এদিন ভিড় ছিল। কথিত ওই প্রতিবন্ধী তার কাঙ্খিত সুবিধা না পেয়ে তার ক্রাচ দিয়ে আঘাত করেন কর্তব্যরত অফিস স্টাফকে। তাহলে বুঝুন তিনি কেমন প্রতিবন্ধী। এছাড়া বুধবার স্কুল কলেজ খোলা। বেলা ১টার সময় প্রতিষ্ঠানের পোষাক পরা অবস্থায় ছাত্ররা ডিসি অফিসের মত জায়গায় কি করছিল? তাদের কি কেউ ডেকে এনেছে? আর তারা স্কুল থেকে বের হল কিভাবে? আসলে তাদের বয়সই বা কত? তাদের কি বলবেন। নানা প্রশ্ন সামনে আসছে যা ভাবার বিষয়। যাহোক তুচ্ছ ঘটনায় ওই কথিত প্রতিবন্ধী পরিবেশ ঘোলাটে করেছে। যা পরে আরো কয়েকটি ঘটনার জন্ম দিয়েছে। ঘটনার মিমাংসা করা হয়েছে শিক্ষক অভিভাবকদের উপস্থিতিতে। তাদের জিম্মায় দেয়া হয়েছে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোর জেলা শাখার সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক বিএম আকাশ জানিয়েছেন, ঘটনার ব্যাপারে তিরি পরে শুনেছেন। ডিসি অফিসে গিয়েছিলেন, জেলা প্রশাসকের সাথে কথাও বলে এসেছিলেন, ঘটনার সন্তোষজনক সমাধান করে দিতে অনুরোধ করে এসেছিলেন। তবে একজন প্রতিবন্ধী কাঁদতে কাঁদতে কেন ফিরে যাবেন ডিসি অফিস থেকে। ডিসি অফিসের কর্মচারীদের আচরণ আসলে কি ছিল। গতকালের ঘটনায় ভুলটা কার ছিল। একটি তদন্ত কমিটি করে পরিস্কার হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে ডিসি অফিসের কয়েক কর্মচারী জানিয়েছেন, ব্রিটিশ ভারতের প্রথম জেলা যশোরের অনন্য পুরাকীর্তির কালেক্টরেট ভবনের সৌন্দর্য্যবর্ধন করা হয়েছে সম্প্রতি। যে কারণে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই ভবন চত্বরে দর্শনার্থী ও সেবাগ্রহীতাদের ভিড় থাকে। কিন্তু স্কুল কলেজ চলাকালীন শিক্ষার্থীরা এখানে এসে আড্ডা দেয়া শুরু করেছে। যা কাম্য নয়। এ কারণে প্রতিনিয়ত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা।

कोई टिप्पणी नहीं मिली