নিউইয়র্ক সিটি রাজনীতিতে এক নতুন ভোরের সূচনা হলো। ভারতীয় বংশোদ্ভূত তরুণ মুসলিম নেতা, জোহরান মামদানি, শহরের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হয়ে এক নতুন ইতিহাস গড়লেন। একজন ডেমোক্রেটিক সমাজবাদী (Democratic Socialist) হিসেবে তাঁর এই জয় কেবল নিউইয়র্কের স্থানীয় ঘটনা নয়, বরং ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে পরিচালিত বিশ্বব্যাপী ডানপন্থী, ইসলামোফোবিক এবং কর্পোরেট-কেন্দ্রিক রাজনীতির জন্য এক কঠিন আদর্শিক ও কৌশলগত ধাক্কা।
এই বিজয়ের তাৎপর্য আন্তর্জাতিকভাবে অনুভূত হয়েছে, বিশেষত ভারতে। জয়লাভের পর দেওয়া প্রথম ভাষণে মামদানি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর ঐতিহাসিক 'নিয়তির সঙ্গে অভিসার' (Tryst with Destiny) বক্তৃতার কালজয়ী অংশ উদ্ধৃত করেন। তিনি বলেন:
“ইতিহাসে খুব কম এমন মুহূর্ত আসে, যখন আমরা পুরাতন থেকে বের হয়ে নূতনের মধ্যে প্রবেশ করি, যখন একটি যুগের সমাপ্তি ঘটে, এবং জাতির আত্মা, যা দীর্ঘকাল ধরে দমন করা হয়েছিল, তার কণ্ঠ খুঁজে পায়।"
এই বক্তব্যটি ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের নেতৃত্বে চলা নেহরু-বিরোধী প্রচারণার মুখে এক করাড়া আদর্শিক জবাব হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। একজন আন্তর্জাতিক মঞ্চে, নেহরুর প্রগতিশীল আদর্শের এই স্মরণ বিশ্বকে এই বার্তা দেয় যে, বহুসাংস্কৃতিক পরিচিতি নিয়েও জনকল্যাণমূলক রাজনীতি সফল হতে পারে।
মামদানি'র নির্বাচনী প্রচারণার মূল ভিত্তি ছিল সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সংগ্রাম। তিনি সরাসরি ওয়াল স্ট্রিট-এর কোটিপতি, ক্রনি ক্যাপিটালিস্ট এবং কর্পোরেট পুঁজির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। একজন গণতান্ত্রিক সমাজবাদী হিসেবে তাঁর মূল প্রতিশ্রুতিগুলি ছিল ধনীদের ওপর কর বাড়িয়ে সেই অর্থ নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য ব্যবহার করা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:
-
সাশ্রয়ী আবাসন (Affordable Housing)
-
বিনামূল্যে বাস পরিষেবা (Free Buses)
-
সার্বজনীন শিশু পরিচর্যা (Universal Child Care)
মামদানি জোর দিয়ে বলেন যে, নিউইয়র্কের খেটে খাওয়া মানুষ "রুটি, কাপড়, আর বাসস্থান" জোগাড় করতে কষ্ট পাচ্ছে। তাঁর এই জমিনি ইস্যু-ভিত্তিক রাজনীতি প্রমাণ করে যে, যখন নেতারা অভিজাতদের স্বার্থ ত্যাগ করে মৌলিক মানবিক চাহিদা নিয়ে কথা বলেন, তখন তা বিশাল জনসমর্থন লাভ করতে পারে।
মামদানি'র বিজয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'মেগা' (MAGA) এবং ঘৃণা-ভিত্তিক রাজনীতির কৌশলকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছে। ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে মামদানিকে আক্রমণ করে 'পাগল কমিউনিস্ট' এবং 'বিপজ্জনক' বলে অভিহিত করেন, এমনকি হুমকি দেন যে মামদানি জিতলে ফেডারেল ফান্ডিং কেটে দেওয়া হবে। কিন্তু নিউইয়র্কের জনগণ এই ভয়-ভিত্তিক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
মামদানি প্রশাসনের হাত ধরে নিউইয়র্কে এখন অভিবাসী অধিকার (Immigration Rights) এবং Sanctuary Policies আরও শক্তিশালী হবে, যা ট্রাম্প প্রশাসনের ICE অভিযান এবং ডিপোর্টেশন ড্রাইভের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় এবং দৃশ্যমান রাজনৈতিক প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করবে। এই জয় ট্রাম্পের সাদা শ্রেষ্ঠত্বের ন্যারেটিভের আদর্শিক পতন নিশ্চিত করেছে।
মামদানি কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন। তিনি প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সামরিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন এবং মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে বলেছিলেন যে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু নিউইয়র্কে এলে তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করবেন। এই ধরনের কঠোর অবস্থান মার্কিন স্থানীয় রাজনীতিতে বিরল, যা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকেও অস্বস্তিতে ফেলেছে।
সার্বিক বিশ্লেষণে, জোহরান মামদানি'র এই ঐতিহাসিক জয় একটি রাজনৈতিক ভূমিকম্প। এটি কেবল নিউইয়র্কের একটি রাজনৈতিক ডাইনেস্টির পতন ঘটিয়েছে, বরং এটি বিশ্বের সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনকারীদের জন্য একটি সফল ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেছে। এই বিজয় প্রমাণ করে যে মুসলিম পরিচিতি নিয়েও মূলধারার রাজনীতিতে এসে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বার্তা দিয়ে সমাজের পুরাতন কাঠামো ভেঙে ফেলা সম্ভব। নিউইয়র্কের জনগণ আজ পুরাতনকে পিছনে ফেলে নূতনের দিকে এক সাহসী পদক্ষেপ নিল, যা বিশ্বজুড়ে রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য।



















