জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকি সামলায় গরিব, সুবিধা নেয় ধনী

Update news 23 avatar   
Update news 23
বিষখালী নদীর তীরে বাস করা রাজিব বলেন, এমন কোনো মাস নেই যে আমাদের উপর প্রকৃতির বৈরী আচরণ না হয়। ধুঁকে ধুঁকে মরে যাই আমরা। কিন্তু দেখা যায় ধনীরা ঠিকই ভালো আছে এবং তারা সুযোগ সুবিধা বেশিই পায়। আমরা চাই ব..


মোঃ হোসাইন সিপাহী 
জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক সংকট আজ শুধু পরিবেশগত নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যেরও প্রতিচ্ছবি। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিব দেশগুলোর  প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। অথচ আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলের সুবিধা ভোগ করে তুলনামূলকভাবে ধনী ও ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীরা। গরিব বা উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষেরা বেশি ঝুঁকিতে বসবাস করে চলছে। 

এমন বাস্তবতা থেকেই উঠে আসে ক্ষুব্ধ প্রশ্ন “ঝুঁকি সামলায় গরিব, সুবিধা নেয় ধনী”—এ কি জলবায়ু ন্যায়বিচারের ধারণাকে ব্যাহত করছে?
বিশ্বের উন্নত ও উচ্চ নিঃসরণকারী দেশগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিল্পায়নের মাধ্যমে বিপুল কার্বন উৎপাদন করে চলছে। 
যার প্রভাব আজ বহন করছে সবচেয়ে কম দায়ী দরিদ্র দেশগুলো। এর মধ্যে বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, লবণাক্ততা, খরা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো সংকটের মুখোমুখি হয়ে চলছে। 
বরগুনার বেতাগী উপজেলার বিষখালী নদীর তীরে বাস করা রাজিব বলেন, এমন কোনো মাস নেই যে আমাদের উপর প্রকৃতির বৈরী আচরণ না হয়। ধুঁকে ধুঁকে মরে যাই আমরা। কিন্তু দেখা যায় ধনীরা ঠিকই ভালো আছে এবং তারা সুযোগ সুবিধা বেশিই পায়। আমরা চাই বৈষম্য না করে টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা হোক। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে অধিকাংশই দরিদ্র, কৃষিনির্ভর, নারী, শিশু ও অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। কিন্তু আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলের প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই জনগোষ্ঠীর কাছে প্রকৃত অর্থ পৌঁছায় খুব কম।
জলবায়ু তহবিল বণ্টনে তিনটি বড় বৈষম্য স্পষ্ট। প্রথমত, দেশভিত্তিক বৈষম্য—বহু উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের প্রশাসনিক দক্ষতা কম বা প্রকল্প প্রস্তুতির সক্ষমতা দুর্বল হওয়ায় তারা পর্যাপ্ত তহবিল পায় না। এর বিপরীতে মধ্যম আয়ের কিন্তু আমলাতান্ত্রিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো বেশি অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোই বঞ্চিত হয়।
দ্বিতীয়ত, খাতভিত্তিক বৈষম্য এর প্রকল্পগুলো কম তহবিল পায়, যেখানে অধিকাংশ গরিব মানুষ অভিযোজনেই বেশি নির্ভরশীল। ধনী দেশগুলো কার্বন কমানোর প্রকল্পে বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেয়, কারণ এতে তাদের প্রযুক্তি, ব্যবসা ও কোম্পানিগুলো লাভবান হয়। অভিযোজন প্রকল্পে সরাসরি মুনাফা কম। ফলে দরিদ্র মানুষের চাহিদা পিছিয়ে যায়।
তৃতীয়ত, অভ্যন্তরীণ বৈষম্য। অনেক ক্ষেত্রেই তহবিল বরাদ্দ হয় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে, যা শহরমুখী ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এলাকাগুলোর উন্নয়ন ঘটায়। উপকূলের জেলে, খেটে খাওয়া মানুষ নদীভাঙনে বাস্তুচ্যুত পরিবার।তাদের হাতে সরাসরি অর্থ বা সুবিধা পৌঁছায় না। ফলে জলবায়ু অর্থায়ন হয় “প্রকল্প–কেন্দ্রিক”, জনগণ কেন্দ্রিক নয়।
বাংলাদেশে কোস্টাল প্রটেকশন, বাঁধ নির্মাণ বা সোলার প্রকল্প এসবের বেশিরভাগ সুবিধা শহরতলী বা মাঝারি আয়ের জনগোষ্ঠী ভোগ করে, অথচ যে জেলাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত যেমন বরগুনা,পটুয়াখালি, সাতক্ষীরা, খুলনা, ভোলা কিংবা সুনামগঞ্জ। সেখানকার জলবায়ু পরিবর্তনে জীবিকানির্বাহ পরিবর্তিয় পরিবারগুলোর হাতে তেমন সুরক্ষা পৌঁছায় না। 

ধনী-গরীব এই বৈষম্য দূর করতে হলে তহবিল বণ্টনে স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি। অভিযোজন তহবিল সরাসরি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। “লোকাল অ্যাডাপ্টেশন ফান্ডিং” মডেলকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে স্থানীয় নারীগোষ্ঠী পর্যন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্ত হতে পারে। প্রকল্প অনুমোদনের সময় “যাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, তাদের অগ্রাধিকার সবচেয়ে আগে” এই নীতি বাধ্যতামূলক করা উচিত।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নত দেশগুলোর কাছে দৃঢ় দাবি উঠেছে—লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল দ্রুত, সহজ ও ধারাবাহিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর কাছে পৌঁছাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতির দায় শুধু দান নয়, নৈতিক দায় ও ন্যায্যতার প্রশ্ন। 

জলবায়ু পরিবর্তন কারও একার সৃষ্ট সমস্যা নয়, কিন্তু ক্ষতি ঝুঁকি বহন করে সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষ। তাই নীতিনির্ধারণের টেবিলে তাদের কণ্ঠস্বর না থাকলে ন্যাধ্যতা প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। জলবায়ু ন্যায়বিচার মানে শুধু অর্থের সুষম বণ্টন নয় এটি মানবাধিকার, সমতা ও নৈতিকতারই দাবি। যতদিন পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের হাতে প্রকৃত সুরক্ষা পৌঁছাবে না, ততদিন এই প্রশ্নই উঠে আসবে।

Geen reacties gevonden


News Card Generator