বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসের অন্যতম চাঞ্চল্যকর অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় এবার গ্রেপ্তার হলেন ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মনিরুল মাওলা। রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকার একটি বাড়ি থেকে রবিবার দিবাগত রাত সোয়া ১২টার দিকে তাকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ডিবির যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম। তিনি জানান, “দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে মনিরুল মাওলাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে আপাতত ডিবি হেফাজতে রাখা হয়েছে। পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।”
গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর, হঠাৎ করেই অফিসে না এসে ই-মেইলের মাধ্যমে পদত্যাগপত্র পাঠান মুহাম্মদ মনিরুল মাওলা। সেই পদত্যাগ নিয়ে তখন থেকেই সন্দেহের দানা বাঁধে। কারণ, তার পদত্যাগের পরপরই প্রকাশ্যে আসে ইসলামী ব্যাংকের হাজার কোটি টাকার এক ভয়াবহ ঋণ জালিয়াতির চিত্র।
দুদকের তদন্তে উঠে আসে, ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এস আলম গ্রুপের মালিক এস আলমসহ মোট ৫৮ জন ব্যক্তি এই দুর্নীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যাংক থেকে নেওয়া হয় ১ হাজার ৯২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই অর্থের বেশিরভাগ অংশই আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে প্রমাণ মেলে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মনিরুল মাওলার নেতৃত্বাধীন প্রশাসনেই ওইসব অর্থ আত্মসাতের প্রক্রিয়া সহজতর হয়েছিল। এমনকি, অভ্যন্তরীণ অডিট রিপোর্টে বেশ কয়েকবার এই অনিয়ম ধরা পড়লেও সেগুলো গোপন রাখা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন মহলের মদদে এস আলম গ্রুপ ও সংশ্লিষ্ট চক্র ব্যাংকের নিয়মবহির্ভূত সুবিধা পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের অপরাধ শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত ‘সিন্ডিকেট দুর্নীতি’। এই চক্র শুধু ইসলামী ব্যাংককেই নয়, পুরো ব্যাংকিং সেক্টরের স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
ব্যাংকিং বিশ্লেষক মোহাম্মদ ইমরান বলেন, এই ঘটনাটি প্রমাণ করে, দেশের বড় বড় ব্যাংকগুলোও দুর্নীতির চোরাবালিতে আটকে আছে। যেসব এমডি ও চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব ছিল স্বচ্ছতা বজায় রাখা, তারাই দুর্নীতির পথ সুগম করেছেন। মনিরুল মাওলার গ্রেপ্তার এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটি বার্তা।
সরকারি পর্যায় থেকেও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির দায় কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। মনিরুল মাওলার মতো শীর্ষ কর্মকর্তারা জড়িত থাকলে, দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
ডিবি জানিয়েছে, মনিরুল মাওলাকে আগামীকাল আদালতে তোলা হবে। তার বিরুদ্ধে রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হবে। মামলার অন্যান্য আসামিদের মধ্যে কয়েকজন ইতিমধ্যে দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন বলে গোয়েন্দা রিপোর্টে উঠে এসেছে। তাদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, শুধু এই একটি মামলাতেই নয়—মনিরুল মাওলার বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি অনিয়ম, লেনদেন গোপনকরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। এসব মামলা প্রমাণিত হলে তার শাস্তি আরও দীর্ঘ হতে পারে।
ইসলামী ব্যাংকের এই বহুল আলোচিত অর্থ কেলেঙ্কারিতে সাবেক এমডির গ্রেপ্তার পুরো দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য এক অশনিসংকেত। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, রাজনৈতিক সংযোগ, আর সিন্ডিকেট ভিত্তিক অপারেশনের কারণে বাংলাদেশে বড় অঙ্কের অর্থ লোপাট এখন যেন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। মুহাম্মদ মনিরুল মাওলার এই গ্রেপ্তার সেই বিপজ্জনক বাস্তবতাকে আবার সামনে এনে দিয়েছে।



















