মধ্যপ্রাচ্যে উত্তপ্ত যুদ্ধ পরিস্থিতির কেন্দ্রবিন্দুতে এখন ইরান ও ইসরায়েল। একের পর এক পাল্টা হামলায় যখন অঞ্চলজুড়ে উত্তেজনা তুঙ্গে, তখন এই সংঘাত ইসরায়েলের জন্য হয়ে উঠেছে এক মারাত্মক বিপর্যয়। কেবল সামরিক পরাজয় নয়, বরং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও কূটনৈতিকভাবে দেশটি যাচ্ছে ভয়াবহ ধসের মধ্য দিয়ে।
বিশ্লেষকদের মতে, যত দিন যাচ্ছে, তত গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। নিচে তুলে ধরা হলো ইরানের সঙ্গে চলমান সংঘাতে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় ১০টি ক্ষতি—যা দেশটির ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।
ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে গিয়ে ইসরায়েল প্রতিদিন গড়ে ৭০০ থেকে ৯০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ব্যয় করছে।
শুধু যুদ্ধের প্রথম দুই দিনেই ইসরায়েলের খরচ দাঁড়ায় প্রায় ১.৪৫ বিলিয়ন ডলার। প্রতিটি অ্যারো বা ডেভিডস স্লিং ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্রের দাম ১ থেকে ৪ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে। এই খরচ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করছে।
ইরান এখন পর্যন্ত ৪০০’র বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়েছে। এসব প্রতিহত করতে গিয়ে ইসরায়েলকে ব্যবহার করতে হচ্ছে দুটি করে ইন্টারসেপ্টর।
ফলে দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে অস্ত্র মজুদ।
এখন এই অস্ত্র প্রতিস্থাপন করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে, এবং তাৎক্ষণিকভাবে মজুদ পূরণ করাও সম্ভব হচ্ছে না।
ইরানের সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের সরোকা মেডিকেল সেন্টার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এই ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ।
ইসরায়েলি সরকার একে সরাসরি যুদ্ধাপরাধ বলে আখ্যা দিয়েছে।
এটি শুধু মানবিক নয়, কৌশলগতভাবেও বড় ধাক্কা।
ইরানি হামলায় বিদ্যুৎকেন্দ্র, পানি পরিশোধন প্ল্যান্ট, তেল ও গ্যাস সংরক্ষণাগারে বিস্ফোরণ ঘটেছে।
এর ফলে দেশজুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহে বড় রকমের বিঘ্ন ঘটছে।
শিল্প-কারখানা, হাসপাতাল এমনকি জরুরি সেবাও এই প্রভাব থেকে বাদ যাচ্ছে না।
সমুদ্রবন্দরে কার্যক্রম প্রায় অচল।
বাণিজ্যিক জাহাজ পরিবহনে বিমার খরচ বেড়ে গেছে তিনগুণ।
ফলে আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানিগুলো ইসরায়েলকে এড়িয়ে চলছে।
এতে করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
যুদ্ধের উত্তাপ পড়ে গেছে তেল রিজার্ভ ও স্টক এক্সচেঞ্জেও।
বিনিয়োগকারীরা ইসরায়েলের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান।
অনেক বড় বড় কোম্পানি সাময়িকভাবে কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে।
ব্যাংক ও বীমা খাতেও অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
স্কুল-কলেজ বন্ধ, বিমান চলাচল অনিয়মিত, রাস্তাঘাট ফাঁকা।
নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েই চলেছে, দিনদিন বাড়ছে মানসিক চাপ।
সরকার প্রতিরক্ষা বাজেট দ্বিগুণ করেছে—৬০ বিলিয়ন শেকেল থেকে ১১৮ বিলিয়ন শেকেল (৩৩.৬ বিলিয়ন ডলার)।
ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কাটছাঁট করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে ইসরায়েলের জনগণের জীবনমানেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ইসরায়েল এখন যুক্তরাষ্ট্রের থাড ও প্যাট্রিয়ট মিসাইল সিস্টেমের ওপর নির্ভর করছে।
কিন্তু এই নির্ভরতা কৌশলগতভাবে একে দুর্বল করে তুলছে।
বিশেষ করে, যদি ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে সরাসরি জড়াতে অনীহা দেখায়, তাহলে ইসরায়েল হয়ে পড়বে অস্ত্র ও প্রযুক্তির দিক থেকে বিপন্ন।
বিশ্লেষকদের মতে, যদি যুদ্ধ ৩০ দিন স্থায়ী হয়, তাহলে ইসরায়েলের ক্ষতির পরিমাণ ১২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
আর যদি যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা কমিয়ে দেয়, তবে ইসরায়েলের অস্ত্র ও রসদের সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
এই বাস্তবতা যুদ্ধে ইসরায়েলের কৌশল এবং ফলাফলকেই পাল্টে দিতে পারে।
ইরান দাবি করেছে, তারা এখনো তাদের পুরো অস্ত্রভাণ্ডার ব্যবহার করেনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি এই দাবি সত্য হয়, তাহলে ইসরায়েলের সামনে অপেক্ষা করছে আরও ভয়াবহ পরিণতি।
এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে, তা কেবল সামরিক নয়, বরং অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ার মত পরিস্থিতি তৈরি করবে।
ইসরায়েলের এই যুদ্ধ শুধু রণক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই।
অর্থনীতি, সমাজ, কূটনীতি—সবকিছুতে ভয়ানক ধাক্কা লেগেছে।
যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, ক্ষতির পরিমাণ তত বেশি হবে।
ইরানের বিপরীতে এককভাবে লড়তে গিয়ে ইসরায়েল যে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে, সেটাই এখন বিশ্ববাসীর সামনে এক কঠিন বার্তা হয়ে উঠেছে।