হিজরতের পঞ্চম বছরে মুসলমানদের জন্য এক মহাসঙ্কট নেমে আসে। শাওয়াল মাসে মক্কার কোরাইশসহ বিভিন্ন আরব গোত্র বিশাল বাহিনী নিয়ে মদিনার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের একটাই লক্ষ্য—ইসলাম ও মুসলমানদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। পরিস্থিতি ছিল এতটাই ভয়াবহ যে, মদিনা যেন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
মুসলমানদের সংখ্যা ছিল নগণ্য, অস্ত্রশস্ত্রও সীমিত। নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবিদের নিয়ে পরামর্শ সভায় বসলেন। কেউ বললেন, বদরের মতো মুখোমুখি লড়াই করা উচিত। কেউ বললেন, মদিনার ভেতরে রক্ষা কৌশল নেওয়া হোক। কিন্তু সেই মুহূর্তেই উঠে এল এক অভাবনীয় প্রস্তাব—ইরানি সাহাবি সালমান ফারসি (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর পক্ষ থেকে।
সালমান ফারসি (রা.) বললেন, ইরানে আমরা যখন এমন বিপদের মুখে পড়তাম, তখন চারপাশে গভীর পরিখা খনন করতাম। শত্রু যাতে সহজে প্রবেশ করতে না পারে।
নবিজি (সা.) এই পরামর্শকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করলেন। কারণ এটি ছিল এমন এক কৌশল, যা আরবের কেউ কখনও ব্যবহার করেনি।
নবিজি (সা.) সিদ্ধান্ত নিলেন—মদিনার উত্তর দিকটি, যেটি ছিল উন্মুক্ত, সেখানে পরিখা খনন করা হবে। অন্যান্য দিক পাহাড় ও ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় সেগুলো ছিল নিরাপদ।
প্রতি ১০ জন সাহাবিকে ৪০ হাত পরিখা খননের দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে খনন কাজে অংশগ্রহণ করেন। সাহাবিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তিনি মাটি কাটতেন, মাটি বহন করতেন। মাত্র ৬ দিনের মধ্যে তাঁরা এমন একটি পরিখা তৈরি করতে সক্ষম হন, যার দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৫,০০০ হাত, প্রস্থ ৯ হাত এবং গভীরতা ৭ হাতের বেশি।
এই পরিখা কেবল একটি গর্ত ছিল না—এটি ছিল এক অসাধারণ কৌশল, যা ইসলামের ইতিহাসে এক মোড় পরিবর্তনকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত।
মুশরিকদের বিশাল বাহিনী এসে দেখে, মদিনার সামনে এক বিশাল পরিখা! তারা চরম হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। কোথাও পরিখা পার হয়ে এগোনোর সুযোগ নেই। তারা চারপাশে ঘুরে দুর্বলতা খোঁজে, কিন্তু কিছুই খুঁজে পায় না।
তারা দূর থেকে তীর নিক্ষেপ করতে থাকে। অন্যদিকে সাহাবিরাও পরিখার পাহারা দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালাতে থাকেন। এক মাস ধরে চলে এই অবরোধ। কোনো পক্ষই মুখোমুখি যুদ্ধ করতে পারে না।
এ এক মানসিক যুদ্ধ, ধৈর্য ও প্রজ্ঞার লড়াই।
ঠিক তখনই আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আসে সহায়তা। প্রবল বাতাস বয়ে যায় শত্রুপক্ষের দিকে। তাদের তাঁবু উপড়ে যায়, আগুন নিভে যায়, মনোবল চূর্ণ হয়। ভয় ও আতঙ্ক তাদের গ্রাস করে। তারা হারিয়ে ফিরে যায়, মুসলমানদের একটি আঁচড়ও কাটতে পারে না।
আল্লাহ তাআলা বলেন—আল্লাহ কাফিরদেরকে তাদের আক্রোশসহ ফিরিয়ে দিলেন, তারা কোনো কল্যাণ লাভ করেনি। যুদ্ধে মুমিনদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। (সুরা আহযাব: ২৫)
খন্দকের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে এক অমূল্য বিজয়। এর পর নবিজি (সা.) বলেন,এখন থেকে আমরাই আক্রমণ করব, তারা আর আমাদের ওপর আক্রমণ করতে পারবে না।” (সহিহ বুখারি)
এই যুদ্ধ দেখিয়ে দেয়—কৌশল, ঐক্য, এবং আল্লাহর উপর ভরসা থাকলে অপ্রতিরোধ্য শত্রুদেরও পরাজিত করা সম্ভব।
পরিখা খনন শুধু একটি সামরিক কৌশল ছিল না—এটি ছিল ঈমান, প্রজ্ঞা এবং ঐক্যের প্রতীক। সালমান ফারসির (রা.) ঐতিহাসিক প্রস্তাব ও নবিজি (সা.)-এর দূরদর্শিতা ইসলামের ইতিহাসে এমন এক অধ্যায় রচনা করেছিল, যা আজও উজ্জ্বল।