হেডলাইন:  সত্য ও মিথ্যা:  সময়ের আয়নায় এক অনন্ত দ্বন্দ্ব

Sampadakiya Anuchchhed avatar   
Sampadakiya Anuchchhed
ডেসক্রিপশন: <br> <br>এই নিবন্ধে সত্য ও মিথ্যার গভীর দার্শনিক দ্বন্দ্ব, তাদের অস্তিত্বগত পার্থক্য, টিকে থাকার কারণ ও পরিণতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আলো ও অন্ধকারের প্রতীকের মাধ্যমে সত্যের শক্তি..

 

 

Author’s Introduction and Publication Details

Author: Bokhtiar Shamim

সত্য- এই ছোট্ট শব্দটির মধ্যে যেন সমস্ত সৃষ্টির ভারসাম্য লুকিয়ে আছে। আর তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে মিথ্যা- চতুর, ছলনাময়, তবে একেবারে হালকা ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এক দুর্বল নির্মাণ। এই দুইয়ের লড়াই সময়ের শুরু থেকেই চলছে, কখনো নিঃশব্দে, কখনো প্রবল বিস্ফোরণে। মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই বাস করে, কখনো সচেতনভাবে, কখনো না জেনেই। সত্য কী? এককথায় বললে, সত্য হলো বাস্তবতা, যা যেমন আছে, ঠিক তেমন করেই প্রকাশিত হয়। এটি শুধু কোনো তথ্যের নির্ভুলতা নয়, বরং এক গভীর অস্তিত্ববোধ, যা বিবেক ও নৈতিকতার সাথে যুক্ত। যখন কেউ বলে, "আমি সত্য বলছি", তখন সে আসলে দাবি করছে- তার অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি ও মনন সবকিছু মিলিয়ে যা সে উপলব্ধি করছে, তা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সত্য সময়ের কাছে দায়বদ্ধ নয়, কারণ সময় পরিবর্তনশীল হলেও সত্য তার স্বরূপে স্থির। সময়ের মধ্যে দিয়ে সত্যের প্রকাশ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু তার অন্তর্নিহিত সত্তা অপরিবর্তনীয়।

অন্যদিকে, মিথ্যা হলো বিকৃত সত্য। কখনো অর্ধেক সত্য, কখনো সম্পূর্ণ কল্পনা- যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাস্তবতার আড়ালে ঢাল তৈরি করে। মিথ্যা প্রায়শই জন্ম নেয় ভয়, লোভ, বা সুবিধাবাদিতা থেকে। মানুষ মিথ্যা বলে নিজের স্বার্থরক্ষায়, কখনো কাউকে আঘাত থেকে বাঁচাতে, আবার কখনো নিজের দুর্বলতা ঢাকতে। কিন্তু এই আবরণ চিরস্থায়ী নয়। মিথ্যা যেমন হঠাৎ আলোড়ন তুলতে পারে, তেমনই হঠাৎ একদিন ধসে পড়ে- কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই। সত্যের ভিত গঠিত হয় প্রমাণ, নৈতিকতা, এবং দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার ওপর। এটি নিজেকে প্রমাণ করার জন্য বাহ্যিক কিছুর ওপর নির্ভর করে না, বরং তার অস্তিত্বেই তার যুক্তি নিহিত থাকে। সত্যের সঙ্গে যুক্ত থাকে আত্মবিশ্বাস, সাহস, এবং সবচেয়ে বড় কথা- শান্তি। সত্য বলার পর ভেতরে একটা প্রশান্তির ঢেউ খেলে যায়। কখনো তা কঠিন হতে পারে, হয়তো তাৎক্ষণিক ক্ষতির কারণও হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি স্থায়ী সুখের পথ উন্মোচন করে।

তবে সত্যের এই পথ সবসময় মসৃণ হয় না। সত্য অনেক সময় একাকীত্বের, কষ্টের ও ত্যাগের নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। সমাজ যেখানে মিথ্যার আলোতে চমৎকার রঙিন ছায়া খুঁজে ফেরে, সেখানে সত্য একা, সাদামাটা ও অনাড়ম্বর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সত্য বলা মানেই অনেকে আপনাকে পছন্দ করবে না, আপনি স্বার্থ হারাবেন, কখনো হয়তো জীবনও বিপন্ন হবে। তবুও সত্যের মাহাত্ম্য এখানেই যে সে কারো কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয় না। সে একা লড়ে, কিন্তু মেরুদণ্ড সোজা করে। সত্যের আলো যেমন নির্মল ও দীপ্তিময়, তেমনই এর একটি অন্ধকার দিকও আছে। সত্য বলে আপনি হারাতে পারেন বন্ধুত্ব, সম্পর্ক, অর্থ বা সামাজিক সম্মান। কিন্তু এই ক্ষয় এক প্রকার আত্মিক পুনর্গঠনের সূচনা করে। যিনি সত্যকে বেছে নেন, তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে চিনে ফেলেন, আত্মজিজ্ঞাসার এক গভীর ধ্যানের মধ্য দিয়ে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন। সত্য তাকে ভাঙে, আবার গড়ে তোলে। এই গঠনে থাকে আত্মমর্যাদা, অন্তর্দৃষ্টি ও চারিত্রিক দৃঢ়তা।

মিথ্যা এর ঠিক বিপরীত। মিথ্যা প্রথমে স্বস্তি দেয়—এক ধরনের নিরাপত্তা। আপনি যদি ভুল করেন এবং সেটি ঢাকতে একটি মিথ্যা বলেন, আপাতদৃষ্টিতে আপনি সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন বলে মনে হয়। কিন্তু সত্য আসলে কখনো চাপা থাকে না। সময়ের স্রোতে কোনো না কোনোভাবে সে ফিরে আসে। তখন সেই একটিমাত্র মিথ্যার জন্য আপনার পুরো বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে। মিথ্যার এই চক্র চলতেই থাকে, একের পর এক জাল বুনতে হয়, প্রতিটি নতুন মিথ্যা আগেরটি টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই কাঠামো এতটাই দুর্বল যে এক জায়গা থেকে ফাটল ধরলে পুরোটা ভেঙে পড়ে। মিথ্যা বিলুপ্ত হয়- এটা কোনো নৈতিক দাবি নয়, বরং বাস্তব পর্যবেক্ষণ। ইতিহাস জুড়ে দেখা গেছে, যত বড় মিথ্যাই হোক না কেন ...শেষ পর্যন্ত তা ধরা পড়ে। হিটলারের মিথ্যা, উপনিবেশিক শাসকদের প্রপাগান্ডা, কিংবা আধুনিক যুগের কোনো রাজনৈতিক বিভ্রম- প্রথমে তা মানুষকে প্রভাবিত করলেও, শেষমেশ সময় তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছে। ইতিহাস এমন এক আয়না, যেখানে সত্যকে ধোঁয়ায় ঢেকে রাখা যায় না। কেউ কেউ হয়তো সাময়িকভাবে মিথ্যার মাধ্যমে ক্ষমতা বা প্রভাব বিস্তার করে, কিন্তু সে প্রভাব চিরস্থায়ী হয় না। কারণ সময়, ইতিহাস, এবং মানুষের অভিজ্ঞতা একসঙ্গে কাজ করে সত্যকে টেনে আনে দৃশ্যমানতায়।

মিথ্যার বিলুপ্তির আরেকটি বড় কারণ হলো- মানুষের অন্তর্গত সত্যবোধ। প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই একটা জায়গায় সত্যকে চেনার এক প্রাকৃতিক প্রবণতা থাকে। এটা সবসময় সক্রিয় না থাকলেও, নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে তা জেগে ওঠে। এই অন্তরাত্মার বোধ মিথ্যার বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে এক মানসিক বিদ্রোহ তৈরি করে। যেমন একজন ব্যক্তি যখন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় মিথ্যাকে মেলাতে পারেন না, তখন তিনি সন্দেহ করতে শুরু করেন। এবং সন্দেহ থেকে প্রশ্ন, প্রশ্ন থেকে অনুসন্ধান, আর অনুসন্ধান থেকে সত্যের প্রকাশ ঘটে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সত্য সবসময় জিতে যায়, বা মিথ্যা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল। অনেক সময় সত্য চাপা পড়ে যায়, মিথ্যা প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো- কতদিন? কতদূর? সত্যের শক্তি হলো ধৈর্য, আর মিথ্যার দুর্বলতা হলো তার তাড়াহুড়া। সত্য অপেক্ষা করে সঠিক সময়ের, আর মিথ্যা চায় তাৎক্ষণিক ফল। এই মৌলিক পার্থক্যই শেষ পর্যন্ত একে অন্য থেকে আলাদা করে। এই জায়গায় এসে প্রশ্ন আসে- তবে আমরা কেন মিথ্যার আশ্রয় নিই? কারণ মিথ্যা সহজ। সত্য যেমন আত্মজিজ্ঞাসা দাবি করে, তেমনি সাহসও চায়। কিন্তু মিথ্যা সুবিধার পথ দেখায়, নিজের দোষ ঢাকার পথ খুলে দেয়, বা যা আমরা হারাতে চাই না, তা রক্ষা করার একটা কৌশল দেয়। তবে এই সুবিধা ক্ষণস্থায়ী। একবার যখন সত্য উন্মোচিত হয়, তখন শুধু সত্যই জিতে যায় না, সেই সঙ্গে মিথ্যার মাধ্যমে যেটা রক্ষা করতে চেয়েছিলাম, সেটাও ধ্বংস হয়ে যায়।

একজন ব্যক্তি যদি সত্যের পথে হাঁটে, তাহলে প্রথমে তার জীবন কঠিন হয়ে উঠতে পারে। মানুষ তাকে অস্বীকার করতে পারে, সমাজ তাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে, এমনকি সে আর্থিক বা সামাজিক ক্ষতির শিকারও হতে পারে। কিন্তু তার আত্মা থাকবে শান্ত, স্থির। অন্যদিকে, মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে কেউ হয়তো কিছু অর্জন করে ফেলতে পারে, কিন্তু তার ভিতরে এক ধরনের ফাঁপা অবস্থান তৈরি হয়, যার কোনো ভিত্তি নেই। সে হয়তো ঘুমাতে পারবে, কিন্তু নিদ্রা হবে অশান্ত। এই দ্বন্দ্ব শুধু ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সমাজ এবং সভ্যতার ভিত্তিতেও এটি বিদ্যমান। একটি সমাজ সত্যকে যত বেশি মূল্য দেয়, সেই সমাজ তত বেশি টেকসই হয়। সত্যভিত্তিক সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, আইন কার্যকর থাকে, আর জনগণের বিশ্বাস অটুট থাকে। অন্যদিকে, মিথ্যার উপর দাঁড়ানো সমাজ হয় ভঙ্গুর—সেখানে অবিশ্বাস, দুর্নীতি, এবং অবিচার দিন দিন বেড়ে চলে। ইতিহাসে বহু সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে শুধু এই কারণে যে তারা মিথ্যার জালে নিজেরাই জড়িয়ে পড়েছিল।

তবে সত্যেরও কিছু মূল্য আছে- এবং সেটা শুধু আর্থিক বা সামাজিক নয়, বরং আত্মিক। সত্য গ্রহণের মানে হলো নিজের সীমাবদ্ধতা মেনে নেওয়া, ভুল স্বীকার করা, এবং পরিবর্তনের পথে হাঁটা। এই যাত্রা সহজ নয়, কিন্তু তা অনিবার্যভাবে একটি মানসিক পরিপক্বতার দিকে নিয়ে যায়। সত্য মানুষকে গড়ে তোলে- ভিতরের দিক থেকে, ধীরে ধীরে, গভীরভাবে। আর মিথ্যা? সে মানুষকে ফাঁপা করে তোলে- বাহ্যিকভাবে জাঁকজমকপূর্ণ, কিন্তু ভেতরে শূন্য। এই আলো-অন্ধকারের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। সত্য যেমন নিঃসঙ্গতার পথে নিয়ে যায়, তেমনই তা শেষ পর্যন্ত আলোয় পৌঁছে দেয়। মিথ্যা যেমন ভিড়ের মধ্যে নিরাপত্তা দেয়, তেমনই তা এক সময় নির্জনতায় ডুবিয়ে দেয়। সত্যের জয় ধীরে হয়, কিন্তু স্থায়ী হয়। মিথ্যার জয় দ্রুত হয়, কিন্তু তা বুদবুদের মতো ভেঙে পড়ে।

আমরা প্রতিদিন এই দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হই- কখনো পরিবারের মধ্যে, কখনো অফিসে, কখনো সমাজে, আবার কখনো নিজের মনেই। প্রতিবার আমাদের বেছে নিতে হয়- আমি কোন পথে যাবো? সহজ কিন্তু ক্ষণস্থায়ী? নাকি কঠিন কিন্তু স্থায়ী? এই প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করে আমাদের চরিত্র, আমাদের ভবিষ্যৎ।একজন মানুষ সত্যকে গ্রহণ করলে, তিনি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন এক আলোকবর্তিকা- যার আলোর কাছে অন্যরাও নিজেকে ফিরে পেতে পারে। সত্য শুধু ব্যক্তিকে মুক্ত করে না, সমাজকেও পরিবর্তন করে। আর মিথ্যা? সে কেবল নিজেকে ধ্বংস করে না, আশেপাশের বিশ্বাস, ভালোবাসা, ও ভরসাকেও টেনে নেয় পেছনে।

শেষ পর্যন্ত, সত্য ও মিথ্যার এই যুদ্ধ শুধু শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এটা চলে হৃদয়ের গভীরে, আত্মার স্তরে। এবং সেখানে, নিঃশব্দ এক পরিণতি ঘটে- যেখানে সত্য, এক বিন্দু আলো হয়ে, অন্ধকার ছিন্ন করে সামনে এগিয়ে যায়।

 

Author’s Introduction and Publication Details

Author: Bokhtiar Shamim

Profile: A distinguished Bangladeshi philosophical poet, fiction writer, columnist, and political language analyst. Renowned for his profound integration of humanistic reflection, philosophical insight, and political expression, Shamim’s work is a unique contribution to world literature. His language resonates with the cadence of contemplation and the sharp edge of socio-political critique, situating him among the rare voices who merge poetic beauty with intellectual clarity.

Tidak ada komentar yang ditemukan