ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়ার পর ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যম কর্মী ও ইউটিউবারদের একাংশ যেভাবে তথ্যগত ভুল, অতিরঞ্জন এবং কূটনৈতিক ষড়যন্ত্রের নামে মিথ্যাচার ছড়িয়ে দিচ্ছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সত্য ও জনগণের ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষাকে বিকৃত করে প্রচার করা এই ধরনের বিভ্রান্তিমূলক বিশ্লেষণ শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এটি দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কের প্রতিও চরম অসম্মান প্রদর্শন করে।
আমরা নিচে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম কর্মী ও ইউটিউবারদের প্রচারিত প্রধান ভুল এবং সেগুলোর সঠিক জবাব তুলে ধরলাম:
১. মিথ্যাচার: 'বিচার নয়, এটি পাকিস্তানের মতো রাজনৈতিক প্রতিশোধ'
ভারতের একাধিক বিশ্লেষক (যেমন শুভঙ্কর মিশ্র, অশোক কুমার পান্ডে) এই রায়কে 'পাকিস্তান ২.০'-এর শো ট্রায়াল (Show Trial) বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফসল বলে আখ্যায়িত করেছেন।
কড়া জবাব:
-
ইতিহাস ও আইনের পার্থক্য: শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের (Assassination) সঙ্গে শেখ হাসিনার ২০২৫ সালের বিচারিক দণ্ডাদেশের (Judicial Sentence) তুলনা করা চরম অজ্ঞতা বা ইচ্ছাকৃত বিকৃতি। একটি ছিল সামরিক খুন, অন্যটি একটি বিশেষ আইনের অধীনে পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের রায়। এই রায়কে পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সঙ্গে তুলনা করা বাংলাদেশের ন্যায়বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি অশ্রদ্ধা।
-
প্রমাণের ভিত্তি: এই দণ্ডাদেশ এসেছে অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের মতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রাজসাক্ষী (Approver) হয়ে সরাসরি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এছাড়া অডিও টেপ, ভিডিও ফুটেজ এবং 'ঘাতক হাতিয়ার' (Lethal Weapons) ব্যবহারের নির্দেশনার প্রমাণ আদালতে পেশ করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা প্রমাণের ওপর নয়, অনুমানের ওপর নির্ভরশীল।
২. মিথ্যাচার: 'গণঅভ্যুত্থানের কারণ কেবল কোটা বা ভাঙচুর'
কিছু বিশ্লেষক (যেমন অভিসার শর্মা) মূর্তিতে ভাঙচুরের মতো প্রতীকী ঘটনাকে বড় করে দেখিয়েছেন, অথবা আন্দোলন কেবল কোটার জন্য ছিল বলে দাবি করেছেন।
-
গণহত্যার কারণেই পদত্যাগ দাবি: জুলাই আন্দোলনের মূল কারণ কোটা ছিল না। মূল কারণ ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত গণহত্যা। যখন আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হলো, যখন শত শত ছাত্র-জনতা নিহত হলো, তখনই জনগণের দাবি কোটা থেকে সরে গিয়ে 'ফ্যাসিবাদী সরকারের পদত্যাগ'-এ রূপান্তরিত হয়। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংঘটিত এই গণহত্যার বিচারের দাবিটিই রায়ের মূল ভিত্তি, কোনো প্রতীকী ভাঙচুর নয়।
-
রাজনীতিতে অতিরঞ্জন: শেখ হাসিনার পুত্রের বক্তব্যকে 'বাংলাদেশের রাস্তায় রক্তের বন্যা বইবে' (রক্ত বহেগা)—এইভাবে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা স্পষ্টতই সাংবাদিকতার নীতি বিবর্জিত এবং পাঠক-দর্শকের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির অপচেষ্টা।
৩. মিথ্যাচার: 'ভারতকে দুর্বল করতে ইউনুস-মার্কিন ষড়যন্ত্র'
কিছু চ্যানেল (যেমন অশোক কুমার পান্ডে) সরাসরি অভিযোগ করেছে যে, জুলাই অভ্যুত্থান একটি মার্কিন-ইউনুস (US-Yunus) ষড়যন্ত্রের ফসল, যার উদ্দেশ্য ভারতকে দুর্বল করা। তারা নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে 'প্রো-পাকিস্তান' হিসেবে তুলে ধরেছে।
-
ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ভ্রান্তি: বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলনকে কোনো বিদেশী শক্তির ষড়যন্ত্র হিসেবে চিত্রিত করা গণ-আকাঙ্ক্ষার প্রতি চরম অসম্মান। যদি একটি সরকারের ১৫ বছরের স্বৈরশাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণহত্যাই তার পতন ঘটাতে না পারে, তবে জনগণের ঐক্যকে কেবল বিদেশি শক্তির চক্রান্ত হিসেবে দেখাটা কর্তৃত্ববাদী সরকারের পুরোনো অজুহাত মাত্র।
-
গণহত্যার বাস্তবতা: আন্দোলনটি কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হলেও, গণহত্যার শিকার হওয়া ছাত্র-জনতার রক্তই এই অভ্যুত্থানকে অনিবার্য করেছিল। এই ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে এড়িয়ে কেবল ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র খোঁজা চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা।
-
ভূ-রাজনৈতিক আতঙ্ক: নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে 'প্রো-পাকিস্তান' হিসেবে প্রচার করা এবং 'বৃহত্তর বাংলাদেশ'-এর মানচিত্রের মতো ভিত্তিহীন গুজব ছড়ানো ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আতঙ্ক ছাড়া আর কিছু নয়। এই ধরনের প্রচারণার মাধ্যমে জনগণের দৃষ্টি আসল সমস্যা থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
৪. মিথ্যাচার: '৫ আগস্টের পর সব ভালো মানুষের সঙ্গে খারাপ হচ্ছে'
কিছু বিশ্লেষক (যেমন রবীশ কুমার) দাবি করেছেন যে, শেখ হাসিনার পতনের পর নতুন সরকার কেবল 'বদলা' নিতে ব্যস্ত এবং সাংবাদিকদের জেলে পুরে গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করছে।
-
ন্যায়বিচার ও প্রতিশোধ: একটি নির্বাচিত নয়, বরং গণহত্যার দায়ে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সর্বোচ্চ নেতার বিচারকে 'প্রতিশোধ' বলাটা ভুল। এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যতে এমন অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধের জন্য একটি কঠোর উদাহরণ তৈরি করে।
-
নিরপেক্ষতার আহ্বান: নতুন সরকারের আমলে যদি কোনো সাংবাদিক বা রাজনৈতিক কর্মীর প্রতি অন্যায় হয়, তবে তার অবশ্যই প্রতিবাদ করা উচিত। কিন্তু সেই প্রতিবাদ করার অর্থ এই নয় যে, বিগত সরকারের গণহত্যার রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করা।
বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনার রায়কে ঘিরে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে অবশ্যই রাজনৈতিক এজেন্ডার ঊর্ধ্বে উঠে দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন করতে হবে। যে ফ্যাসিবাদী শাসকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা নিজেরা রক্ত ঝরিয়ে, জীবন দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, সেই রায়কে 'রাজনৈতিক প্রতিশোধ' হিসেবে প্রচার করা অগ্রহণযোগ্য।
ভারতকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশের জনগণ ন্যায়বিচার চেয়েছে। এই রায় কেবল শেখ হাসিনার দণ্ড নয়, এটি গণতন্ত্রের পথে গণহত্যার অপরাধীদের জন্য এক কঠিন বার্তা। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে ভারতের সাংবাদিকদের উচিত—ভুয়া তথ্যের প্রচার বন্ধ করে বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।



















