গেস্টরুম সংস্কৃতির অবসান: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নতুন অধ্যায়, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জোরালো


বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রলীগের ‘গেস্টরুম’ নির্যাতন সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল। শিক্ষার্থীদের হলগুলোতে থাকতে হলে ছাত্রসংগঠনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল, যা শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠেছিল। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই অনৈতিক সংস্কৃতির অবসান ঘটেছে। বর্তমানে হলগুলোতে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের দখলদারত্ব নেই এবং শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক পরিবেশে বসবাস করতে পারছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন চিত্র
আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল ছাত্রলীগের হাতে। কোন শিক্ষার্থী কোন কক্ষে থাকবে, তা নির্ধারণ করতেন ছাত্রলীগের নেতারা। বিশেষ করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশ নিতে হতো। গণরুমে গাদাগাদি করে থাকার পাশাপাশি গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার হতেন তাঁরা।
৫ আগস্টের আগে, গত বছরের ১৬ জুলাই রাতে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়। এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র বদলে যায়। এখন হলে রাজনৈতিক গণরুম নেই, গেস্টরুম নির্যাতন বন্ধ হয়েছে এবং প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে মেধা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে হলে আসন বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। তবে অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর কারণে কিছু হলে এখনো গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে।
অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবর্তন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: গত ১৬ জুলাই রাতে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে হল থেকে বিতাড়িত করে। এরপর কনিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা নিজেদের আসন বুঝে পেয়েছেন। র্যাগিং এবং গেস্টরুম নির্যাতন বন্ধ হয়েছে, ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্কের পরিবেশ নেই। তবে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আলোচনা চলছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: ৫ আগস্টের পর কোনো ছাত্রসংগঠনের দখলদারত্ব নেই। গত ৪ অক্টোবর দীর্ঘ সাত বছর পর হলে আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা মেধার ভিত্তিতে আসন পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত ২০টির বেশি কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: আগে ছাত্রলীগের নানা অনিয়ম ও সিট বাণিজ্যের কারণে শিক্ষার্থীরা ভোগান্তির শিকার হতেন। কিন্তু বর্তমানে প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে আসন বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের কোনো অভিযোগ নেই, তবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় সংকট রয়ে গেছে। উপাচার্য জানিয়েছেন, চলতি ফেব্রুয়ারি মাসেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়: আগে হলগুলো ছাত্রলীগের দখলে থাকলেও এখন শিক্ষার্থীরা মেধার ভিত্তিতে হলে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। ২০২৩ সালে ছাত্রী ফুলপরী খাতুনের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতনের ঘটনা আলোচিত হয়েছিল, তবে গত ছয় মাসে ক্যাম্পাসে এমন কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়: ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম থাকলেও কোনো সংগঠনের একক আধিপত্য নেই। গেস্টরুম নির্যাতন ও গণরুম সংস্কৃতি বন্ধ হয়েছে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জোরালো হচ্ছে
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি প্রবলভাবে উত্থাপিত হচ্ছে। প্রশাসন এই বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা ও পরিকল্পনা করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় চালিয়ে যাচ্ছে।
উপসংহার
৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলগুলোতে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা ফিরেছে, গেস্টরুম নির্যাতনের অবসান হয়েছে এবং দখলদারিত্বের রাজনীতি থেকে মুক্ত হয়েছে শিক্ষাঙ্গন। তবে শিক্ষার্থীদের মৌলিক চাহিদা ও শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়নের জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন জরুরি হয়ে উঠেছে। এখন দেখার বিষয়, প্রশাসন কত দ্রুত এই দাবির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারে।
कोई टिप्पणी नहीं मिली