ফিফা কেন ইসরায়েলকে শাস্তি দেয় না? আন্তর্জাতিক ফুটবলে সাম্রাজ্যবাদের চিত্র..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
গাজার ওপর ইসরায়েলি আক্রমণের পর, ফিলিস্তিন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও ফিফা কেন এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে না, তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট..

ফিফা কেন ইসরায়েলকে শাস্তি দেয় না?
ফুটবল বিশ্বের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার নীরবতা এবং রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে এক প্রশ্ন উঠেছে, যখন গাজার ওপর ইসরায়েলি আক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত ১৮ মার্চ থেকে গাজায় পুনরায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর হামলা শুরু হয়, যার ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হন এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ আহত হন। একদিকে, ফিলিস্তিন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (পিএফএ) আন্তর্জাতিক ফুটবল দুনিয়ায় ইসরায়েলি ক্লাবগুলোর অবৈধ উপস্থিতি এবং সামরিক আগ্রাসনের বিষয়টি তুলে ধরে ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার জন্য ফিফার কাছে আবেদন জানিয়েছে। তবে ফিফা কেন এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না? এই প্রশ্নের উত্তরে ফুটবল বিশ্বের রাজনীতি, ধর্ম এবং সাম্রাজ্যবাদের গভীর সম্পর্ক উঠে এসেছে।

ফিফা এবং রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা
২০১৭ সালে, ফিফা তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছিল যে তারা ‘রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকবে’। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কেন তাদের এই নিরপেক্ষতা শুধুমাত্র কিছু দেশ, যেমন ইসরায়েলের ক্ষেত্রে বজায় রাখা হয়? যখন ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর, ফিফা দ্রুত রাশিয়াকে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কার করেছিল, তখন কি এই ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’ ছিল? আন্তর্জাতিক ফুটবলে ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার জন্য ফিলিস্তিনের দীর্ঘদিনের দাবি, ফিফা কেন সেটি উপেক্ষা করছে, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে।

১৯৭৮ বিশ্বকাপ এবং আর্জেন্টিনার সামরিক জান্তা
ফিফার এই দ্বিচারিতা নতুন নয়। ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনার সামরিক জান্তার শাসন চলাকালে, যেখানে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ‘নিখোঁজ’ হয়ে যান এবং নির্যাতন চালানো হয়, তবুও ফিফা আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে দেয়। হোর্হে রাফায়েল ভিদেলার স্বৈরশাসনের সময়ে, ফিফা আর্জেন্টিনার সামরিক সরকারকে সমর্থন দিয়ে তাদের বিশ্বকাপ আয়োজনের অনুমতি দিয়েছিল, যা ফুটবল ইতিহাসে একটি বিতর্কিত অধ্যায় হয়ে আছে।

ফিলিস্তিন এবং গাজায় ফুটবল ধ্বংসযজ্ঞ
গাজার ফুটবল অবকাঠামো এবং অ্যাথলেটদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা তীব্রতর হয়েছে। গাজার যেসব ফুটবল স্টেডিয়াম এবং প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র ছিল, সেগুলি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গাজার বিখ্যাত ‘ইয়ারমুক স্পোর্টস অ্যারেনা’, যেটি একসময় ৯ হাজার আসনবিশিষ্ট ফুটবল স্টেডিয়াম ছিল। এখানে যেসব ফুটবল প্লেয়াররা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন, তাদের অনেকেই ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন। এমনকি ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ৭০৮ জন ফুটবলার নিহত হয়েছেন। ফিলিস্তিনের ফুটবল ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, যেমন হানি আল-মাসদার এবং মোহাম্মদ বারাকাত, ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন।

ইসরায়েল এবং আন্তর্জাতিক ফুটবলে তার অবস্থান
ফিলিস্তিন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (পিএফএ) ১৯৯৮ সালে ফিফার সদস্যপদ পাওয়ার পর থেকেই ইসরায়েলের ফুটবল ক্লাবগুলোর বিরুদ্ধে এরকম দাবি ওঠে। ফিফা সেসময়ও একে এড়িয়ে যায়। এছাড়া, ইসরায়েলি ফুটবল ক্লাবগুলো অনেক সময় ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে অবৈধভাবে তাদের খেলাধুলা পরিচালনা করেছে, যা ফিফার নিয়মাবলীর বিরোধী।

ফিফা এবং ইউরোকেন্দ্রিকতা
ফিফা, যেটি ১৯০৪ সালে ইউরোপীয় শক্তির হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আজও ইউরোপ কেন্দ্রিকভাবেই পরিচালিত হয়। এর ইতিহাসে একমাত্র আফ্রিকার ফুটবল মহল বিশ্বকাপ বর্জন করেছিল ১৯৬৬ সালে। তখন ইউরোপীয় শক্তির বিরুদ্ধে আফ্রিকান ফুটবল কনফেডারেশন প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্বকাপ বর্জন করেছিল। যদিও পরে তাদের দাবি মেনে নেওয়া হয় এবং ১৯৭০ বিশ্বকাপে আফ্রিকার জন্য স্থায়ী জায়গা রাখা হয়। এই ধরনের ঔপনিবেশিক বঞ্চনা এবং ফিফার ভূমিকা এখনও ফুটবল বিশ্বের নীতিগত দ্বৈততার প্রমাণ।

ফিলিস্তিনের পতাকা এবং ফুটবলের সংহতি
এখন, যখন পৃথিবীজুড়ে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়ছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি প্রদর্শন করা হচ্ছে, তখন ফিফা তার নীরবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সেল্টিক সমর্থকরা ‘ইসরায়েলকে লাল কার্ড দেখাও’ প্রচারণা শুরু করেছেন এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে অনেকেই তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। তবে ফিফা তার দীর্ঘদিনের নীরবতায় ইসরায়েলকে শাস্তি দিতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

এদিকে, গাজার ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি, ফিলিস্তিনের ফুটবল সংহতি দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, ফিলিস্তিন জাতীয় ফুটবল দল প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ফিলিস্তিনের মানুষ প্রতিরোধ সংগ্রামে, ফুটবলকে তাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছে।


এইভাবে, ফিফার নীরবতা এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণফুটবল সংক্রান্ত পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়টি ফুটবল বিশ্বকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে, এবং ফিলিস্তিনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন দিন দিন বাড়ছে।

Комментариев нет