মোবারকগঞ্জ স্টেশন থেকে লিখছি আমি, এক অবুঝ মোরগ।মোবারকগঞ্জ স্টেশনটা আমার ঘর। প্রতিদিন সূর্য উঠতেই আমার চোখে পড়ে ছুটে চলা ট্রেন, মানুষের ব্যস্ততা, অগণিত মুখ, অগণিত গন্তব্য। আমি এখানে থাকি, খাই, হাঁটি, ঘুরে বেড়াই – আর দেখি, দেখি মানুষের জীবন। আমি কোনো মানুষ নই, আমি একজন মোরগ। কিন্তু আমার জীবনটা কোনো মানুষের চেয়ে কম বিচিত্র নয়।
ছোটবেলা থেকেই আমি আলাদা ছিলাম।
অন্য মোরগেরা যখন খাবার নিয়ে লড়াই করতো, আমি তখন এক কোণে বসে আকাশ দেখতাম।
নিজেকে বলতাম—
"ভালোবাসা চাই, ঝগড়া নয়। কাউকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে চাই..."
একদিন হঠাৎ করেই সে এল – এক মুরগী।
গায়ের পালক ঝকঝকে, চোখে তীক্ষ্ণ চাহনি। হাঁটার ভঙ্গিতে যেন ঝড় তোলে।
আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
"তুমি কি সব সময় এত চুপচাপ থাকো?"
আমি লাজুক হেসে বললাম,
"সবাই যখন বলে, তখন না বলাটাও একধরনের ভাষা।"
তখন থেকেই আমি ওর ছায়া হয়ে উঠলাম। চায়ের কাপে মুখ দিলাম, লং ড্রাইভে পেছনে ছুটলাম।
প্ল্যাটফর্মের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতাম, শুধু ওর চোখে চোখ রাখতে।
একদিন সে বলল,
"তুমি খুব অন্যরকম। তুমি থাকলে মনে হয় কেউ সত্যিই আমার পাশে আছে।"
আমি মনে মনে বললাম,
"তুমি শুধু বলছো, আমি তো থেকেই গেছি..."
কিন্তু সময়ের সাথে বদলে গেলো অনেক কিছু।
আমি দেখলাম, সে এক এক করে ঘুরে বেড়ায় অন্য মোরগদের সাথে।
ওদের দেওয়া উপহারে হাসে, সময় কাটায়, আর আমার দিকে ফিরে তাকায় না।
তাও চুপ করে থাকতাম। একদিন জিজ্ঞেস করলাম—
"তুমি কি জানো, আমি সব দেখি?"
সে হেসে বলল,
"দেখো, কিন্তু বোঝো না। সব সম্পর্ক সমান হয় না।"
সেদিন আমার ভেতরে কিছু ভাঙলো।
শেষবার যখন ওকে অন্য এক মোরগের ডানা ছায়ায় হাসতে দেখলাম, নিজের মনেই বললাম,
"আমি লয়াল ছিলাম, কিন্তু সে তো কখনোই আমার ছিল না।"
সেদিনই আমি ভাঙলাম – একজন লয়াল মোরগ হিসেবে।
আর গড়ে উঠলাম নতুন এক রূপে – একজন দয়াল মোরগ হিসেবে।
এখন আমি আর কাউকে দোষ দিই না। প্রতিটি যাত্রীর মুখে খুঁজি একটুখানি ব্যথা, কারণ আমিও একসময় ব্যথিত ছিলাম।
একদিন এক শালিক এসে পাশে বসে বলল,
"তুমি কেন এত চুপ?"
আমি বললাম,
"চুপ থাকা শিখেছি... ভালোবেসে ভুল করে।"
শালিকটা আমার পাশে থাকে, কিছু বলে না – তবুও বোঝে।
আজ আমি আর ভালোবাসা খুঁজি না, শুধু ভালোবাসি – নিঃস্বার্থভাবে।
"দেয়াল হতে শিখেছি, লয়াল থেকে দয়াল হবার এই যাত্রায়।"
মোবারকগঞ্জ স্টেশনটা বদলায় না। ট্রেন আসে, ট্রেন যায়।
আর আমি – আমি চুপচাপ বসে থাকি। একা, কিন্তু শান্তিতে।
মোবারকগঞ্জ, ঝিনাইদহ
২১ মে, ২০২৫



















