একাকী অনন্তে
১
কলমে: দেলওয়ারা মিনা
আলমারির ভেতর লুকানো এক জোড়া পুরনো শাড়ি,
যার ভাঁজে ভাঁজে জমে আছে অপ্রকাশিত যাপনের ধুলো।
হাতছানি দেয় কিছু পুরনো চিঠি, যেগুলো লেখা হয়নি,
যেগুলোর উত্তরও ছিল না, তবু তারা থেকে গেছে জীবনের হোল্ডারে।
একটা ফ্রেমে হাসছেন তিনি- যিনি একদিন বলেছিলেন, তুমি আছো, এটাই যথেষ্ট।
আজ শুধু আমি আছি, তিনি নেই, কথাগুলো থেকেও নিঃস্ব।
ঘরের কোণে বাজে না আর কোনো গানের সুর,
রেডিও’র সুইচ ঘোরালেও ফিরে আসে শুধু খালি হাওয়া।
চায়ের কাপ রাখি টেবিলে- সে আর আগের মতো গরম থাকে না,
তেমনি আমিও আর আগের মতো প্রাণবন্ত নই।
আয়নার সামনে দাঁড়ালে মনে হয়- নিজেকেই চিনতে পারি না,
এই মুখ, এই চোখ- নাকি কেবল এক মৃত সমাহার?
নানারকম দিব্যি দিয়ে ছেলেমেয়েরা সুখ কিনে ফেলেছে,
তাদের হেঁসে ওঠা আমার হাহাকারের বিপরীতপথে হাঁটে।
তারা ভাবে আমি আর কষ্ট পাই না- এটা বোঝা যায় না ফেসবুকে,
সেখানে আমার ছবিতে লাইক পড়ে, কিন্তু ভিতরের শূন্যতা কে জানে?
যেমন জানে না কেউ, দুপুরবেলার নিঃসঙ্গতা কেমন ক্ষুধার থেকেও বেশি কষ্ট দেয়,
অথবা সন্ধ্যাবেলায় দরজায় কড়া নাড়ে না কোনো মানুষের হাত।
একাকী অনন্তে
২
কলমে: দেলওয়ারা মিনা
আলো আসে জানালায়, কিন্তু আমার ঘরে আর আলো পড়ে না,
সূর্য ওঠে ঠিকই, তবু আমার ভোর হয় না হৃদয়ের ভিতর।
ফুল ফোটে বাগানে, কিন্তু আমার বুকে কাঁটাই চাষ হয়,
কারণ আমি নারী- যার অনুভবকে অনেকেই বুঝে না ইচ্ছাকৃত।
আমি কথা বলি না বলে কেউ ভাবে আমি কিছু ভাবি না,
কিন্তু নীরবতা মানে কখনো কখনো সবচেয়ে গভীর চিৎকার।
বিয়ের সেই শাড়ি, গয়না, ছবি- সবই আছে এখনো বাক্সবন্দী,
তবু স্বামীহীন এক পৃথিবীতে ওসব শুধুই অতীতের প্রতিচ্ছবি।
যে বালিশে একদিন তাঁর ঘ্রাণ ছিল, আজ সেটিও নিঃসংশয়,
মাথা রাখি ঠিকই, কিন্তু ঘুম আর নামে না চোখে।
মেয়েরা যখন বড় হয়, তখন তারা নিজেরা নিজেদের মা হয়ে যায়,
আমি তাই নিজের ভেতরেই এক পাষাণ মা, এক আহত কন্যা।
একাকী অনন্তে
৩
কলমে: দেলওয়ারা মিনা
রাত্রি এসে জানায়- তোমার জন্য কোনো চিঠি নেই আজও,
আর আমার হৃদয় উত্তর দেয়- জানি, আশা করিনি তবুও অপেক্ষা করেছি।
বিছানার পাশে রাখা চশমাটা আর চোখে তুলি না,
কারণ কাঁদলে দৃষ্টিও ঝাপসা হয়, দেখে আর কি হবে?
ভালোবেসে ভুল করেছি না, ভুল করেছি নিজের ভালোবাসায় ডুবে গিয়ে,
যেখানে আমার না বলা কথার বোঝা আমি নিজেই বই।
আজকাল খবর পড়ি না, তবু জানি- জগৎ বদলে গেছে,
তবু নারীর কান্নার রং বদলায়নি একবিন্দু!
অফিসে ব্যস্ত ছেলে, রান্না করতে করতে ক্লান্ত মেয়ে,
আর আমি নিঃশব্দে গাই- এই সময় যেন আমাকে ছুঁয়ে না যায়।
বাইরে উৎসব হলে, আমি পর্দার আড়াল থেকে দেখি,
আর ভাবি- আমার আত্মা কি আজও কোথাও আমায় খোঁজে?
একাকী অনন্তে
৪
কলমে: দেলওয়ারা মিনা
জীবনের বইয়ে অনেক পৃষ্ঠা ছিল যেগুলো ভাঁজ খোলাই হয়নি,
কেউ জানেনি- সেসব পাতায় লেখা ছিল নীরব বিপ্লব।
আমি একা, ঠিক আছে; একাকীত্বে আমি নিজেকে গড়েছি নতুন করে,
যেখানে না থাকলেও কেউ, আমি ছিলাম, আছি- অস্তিত্বে, সাহসে।
যারা ভেবেছে আমি হারিয়ে গেছি, তারা জানুক- আমি শুধু নীরব হয়েছি,
কারণ কিছু যন্ত্রণা চিৎকারে নয়, চুপ করে বহনেই বাঁচে।
একদিন আমার গল্প কেউ পড়বে, হয়তো কেবল একজন,
কিন্তু সেই একজন বুঝবে- নারীর চোখে কীভাবে সাগর গড়ে ওঠে।
জীবনের প্রতিটি অপমান আমি রূপ দিয়েছি অভিজ্ঞতায়,
প্রতিটি অশ্রুকে গেঁথেছি আত্মমর্যাদার মালায়।
একাকী অনন্তে আমি এক নারী, এক পুর্ণগ্রহ- চাঁদ চাই না পাশে,
আমার নক্ষত্র আমি নিজেই, আমি নিজেই আমার ভোর।
কবিতা
একাকী অনন্তে
১/৪
দেলওয়ারা মিনার কবিতায় নারীজীবনের নিঃসঙ্গ সৌন্দর্য ও আত্মমর্যাদার জাগরণ
দেলওয়ারা মিনা- বগুড়া শহরের একজন প্রাজ্ঞ ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লেখিকা, যিনি নিঃশব্দে কিন্তু গভীরভাবে নারীর অভ্যন্তরীণ জগৎ, জীবনের অতলবেদনা, এবং আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানকে তুলে ধরেছেন তার কবিতায়।
তাঁর "একাকী অনন্তে" শীর্ষক চারটি কবিতা যেন এক মহাকাব্যিক আত্মকথন- একটি নারীসত্তার নিঃসঙ্গতার মধ্যেও শক্তিকে খুঁজে পাওয়ার গল্প।
এই কবিতাগুলো শুধু আবেগের প্রকাশ নয়; এগুলো একেকটি জীবনসত্যের দলিল। পুরনো শাড়ির ভাঁজে জমে থাকা অতীত, না লেখা চিঠির ভাষাহীনতা, ফ্রেমে বন্দী এক প্রিয় মুখের স্মৃতি- সব মিলিয়ে কবিতাগুলোর শুরুটা এক নিঃসঙ্গ, স্মৃতিভারে নুয়ে পড়া জীবনের আভাস দেয়।
তবে সেখানেই আটকে থাকেন না মিনা। তিনি নিজের যন্ত্রণাকে ভাষা দেন, কিন্তু তাকে দুর্বলতা হিসেবে দেখান না। বরং জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি নির্মোহ, সংবেদনশীল এবং ধীরে ধীরে আত্মনির্ভর হয়ে ওঠে।
প্রথম কবিতায় তিনি বলেন, তুমি আছো, এটাই যথেষ্ট- এই একটি বাক্য যে এক নারীর জন্য কতটা অবলম্বন হতে পারে, তা তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেন। অথচ সেই মানুষ না থাকলে কীভাবে জীবনের প্রতিটি কোণ শূন্যতায় ভরে যায়, তার প্রতিচ্ছবিও তিনি এঁকে দেন নিঃশব্দ শব্দচিত্রে।
দ্বিতীয় কবিতায় এসে তাঁর কণ্ঠ আরেকটু দৃঢ়, যেখানে তিনি সমাজের সেই চিরকালীন ভুল ধারণার প্রতিবাদ করেন- যেখানে চুপ থাকা মানেই অনুভবহীনতা।
তিনি বলেন, নীরবতা মানে কখনো কখনো সবচেয়ে গভীর চিৎকার। এই চরণেই লুকিয়ে আছে একজন নারীর আত্মার কান্না, যা কখনো শব্দে উচ্চারিত হয় না, তবু সর্বদা বহমান।
তৃতীয় কবিতাটি যেন এক অব্যক্ত প্রতীক্ষার প্রতিচ্ছবি। রাতে চিঠি না পাওয়ার দুঃখ, চশমা না পরার সিদ্ধান্ত, খবর না পড়ার অভ্যাস- সবকিছুতেই ফুটে ওঠে এক নারীর ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া,
অথচ ভেতরে তার নিজের সঙ্গেই এক সাহসী মৈত্রী গড়ে তোলা। তিনি ভালোবেসে ভুল করেননি, বরং ভালোবাসার গভীরতায় নিজেকে হারিয়েছিলেন। এই উপলব্ধি তাঁর জীবনের নির্যাস।
চতুর্থ কবিতায় এসে দেখা যায়, মিনা আর কেবল এক শোকাহত নারী নন- তিনি পরিণত এক আত্মসত্তা। অতীতের না পড়া পৃষ্ঠাগুলো আজ তাঁর নীরব বিপ্লবের নিদর্শন। তিনি বলেন, আমি একা, ঠিক আছে; একাকীত্বে আমি নিজেকে গড়েছি নতুন করে। এ যেন নিঃসঙ্গতাকেও এক শিল্পে রূপ দেওয়ার উদাহরণ।
এখানে দেলওয়ারা মিনার জীবনদর্শন এক অনবদ্য চূড়ান্ততায় পৌঁছায়- নিজের ভেতরেই তিনি পূর্ণ, তিনি নিজের জন্য যথেষ্ট। চাঁদ নয়, তিনি নিজেই তাঁর নক্ষত্র।
দেলওয়ারা মিনার কবিতা আমাদের জানায় যে, নারীজীবনের প্রতিটি অভিমান, প্রত্যাখ্যান এবং নিঃসঙ্গতা একটি বড় উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়। তিনি সমাজের এক দর্পণ, যিনি নিরবে দেখিয়ে দিয়েছেন- আত্মসম্মান আর আত্মশক্তিই একজন নারীর প্রকৃত সৌন্দর্য।
"একাকী অনন্তে" কেবল একটি কাব্যিক সৃষ্টি নয়; এটি এক সংগ্রামী নারীসত্তার, এক জীবন্ত দর্শনের কণ্ঠস্বর, যা অনন্ত একাকীত্বের মধ্যেও নিজেকে পুনঃআবিষ্কারের আশ্বাস দেয়।
এই লেখাগুলো প্রমাণ করে, দেলওয়ারা মিনা শুধুই একজন কবি নন- তিনি একজন অনুভবী দর্শনচর্চাকারী, যাঁর কলমে নারীর নিরবতা কথাময় হয়ে ওঠে।