close

কমেন্ট করুন পয়েন্ট জিতুন!

ড. ইউনূসের চীন সফর : কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন চীন সফর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যখন বাংলাদেশ ও চীন তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন করছে..

২০২৫ সাল বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। কারণ এ বছর দুই দেশ তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছে। গত পাঁচ দশকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে, বিশেষ করে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে। চীন বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং একাধিক বড় অবকাঠামো প্রকল্পের প্রধান অর্থায়নকারী। যদিও চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য, কিছু ক্ষেত্রে ঋণনির্ভরতা ও নির্দিষ্ট প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এই প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূসের সফর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এটি একদিকে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করার সুযোগ সৃষ্টি করবে, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অংশীদারির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও মূল্যায়ন করবে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে। যদিও নতুন কিছু প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এই সফরের মূল লক্ষ্য হবে বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

তবে বিআরআইয়ের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধ ও সম্ভাব্য ‘ঋণের ফাঁদ’ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। চীন এরই মধ্যে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দিলেও সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা কম। ড. ইউনূস এই বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা করবেন, তবে চীনের অর্থনৈতিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতার কারণে বড় ধরনের ছাড় পাওয়া কঠিন হতে পারে।

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। যদিও একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, বাস্তব আলোচনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এই সফরে চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকলেও উভয় পক্ষের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীর করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হবে।

এই সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে পারে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ-চীন সহযোগিতা। চীন প্রস্তাব দিয়েছে যে কুনমিং শহরের চারটি হাসপাতাল শুধু বাংলাদেশি রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা হবে এবং ঢাকায় একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণে সহায়তা করা হবে। এটি শুধু স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন নয়, বরং কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের জন্য আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চীনের সমর্থনে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে ভারত আপত্তি তুলেছে, অন্যদিকে চীনের ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশেও উদ্বেগ রয়েছে। ড. ইউনূস এই বিষয়গুলো উত্থাপন করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে চীন সম্ভবত এ ধরনের সংবেদনশীল ইস্যুতে বিস্তারিত আলোচনায় যেতে চাইবে না।

বাংলাদেশ ও চীন উভয়ই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হিসেবে প্রত্যাবাসনকে সমর্থন করে, তবে কার্যকর অগ্রগতি এখনো আশানুরূপ হয়নি। এই সফরে মানবিক তহবিল বাড়ানো ও মায়ানমারের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা প্রসঙ্গে চীনের আরো সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হতে পারে। রোহিঙ্গা ইস্যু এই সফরেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ড. ইউনূসের চীন সফর মূলত বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ককে আরো সুসংহত করার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। তবে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বা কূটনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা কম। সফরের মাধ্যমে মূলত অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহযোগিতাকে আরো শক্তিশালী করার দিকেই জোর দেওয়া হবে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করার পাশাপাশি বাংলাদেশ তার ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখবে।

চীন ভালোভাবেই জানে যে বর্তমান সরকার জনপ্রিয় হলেও অভ্যন্তরীণ ও কাঠামোগত চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এই পরিস্থিতি বেইজিংকে শক্তিশালী ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি, চুক্তি বা সমঝোতায় এখনই সম্পৃক্ত হতে কিছুটা সংযত রাখবে।

বাংলাদেশের জন্য এই সফর তার মূল অগ্রাধিকারগুলোকে সামনে তুলে ধরার একটি বড় সুযোগ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং আন্তঃসীমান্ত ইস্যুতে জোর দেওয়া হবে, একই সঙ্গে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হবে যে বাংলাদেশ কোনো একক অংশীদারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হবে না।

যদিও আলোচনাগুলো মূলত আকাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা ও ভবিষ্যৎ অংশীদারির কাঠামোর ওপর গুরুত্বারোপ করবে, বাস্তব ও তাত্ক্ষণিক অগ্রগতি সীমিত থাকার সম্ভাবনাই বেশি। উভয় পক্ষই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির চেয়ে সতর্ক কূটনৈতিক পন্থাকে অগ্রাধিকার দেবে। ফলে এই সফর পরিবর্তনমূলক ফলাফল প্রদানের চেয়ে ভবিষ্যৎ সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে।

کوئی تبصرہ نہیں ملا


News Card Generator