ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা আঞ্চলিক উত্তেজনা এক নতুন ও ভয়াবহ মোড় নিয়েছে। সর্বশেষ অভিযোগ— ইরান আকাশপথে ক্লাস্টার বোমা নিক্ষেপ করেছে, যা সাধারণ মানুষের ওপর বিপুল ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই ধরণের বোমা যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য নকশা করা হলেও, এর প্রভাব বেসামরিক এলাকাকে দীর্ঘমেয়াদে বিপর্যস্ত করে তোলে।
বৃহস্পতিবার (স্থানীয় সময়) ইসরায়েল সরকার এক বিবৃতিতে জানায়, ইরান থেকে নিক্ষেপ করা একটি ক্ষেপণাস্ত্র মাঝ আকাশে বিস্ফোরিত হয়ে শত শত ছোট বোমা ছড়িয়ে দেয়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি অনুযায়ী, এটি ছিল একটি ক্লাস্টার মিউনিশন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বেসামরিক লোকজনের মধ্যে ভয় ও ধ্বংস ছড়ানো।এই প্রথমবারের মতো ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষে ক্লাস্টার বোমার অভিযোগ সামনে এলো, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
ক্লাস্টার বোমা হলো এমন একটি ঘাতকাস্ত্র, যার মূল শরীরের ভেতর থাকে অসংখ্য ক্ষুদ্র সাবমিউনিশন বা ছোট বোমা। এটি আকাশ থেকে নিক্ষেপ করার পর মাঝপথেই বিস্ফোরিত হয়ে সেই ক্ষুদ্র বোমাগুলো বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে দেয়।
এই বোমাগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বিস্ফোরণ ঘটালেও অনেকগুলো থেকে যায় অবিস্ফোরিত অবস্থায়। সেগুলো পরবর্তী সময়ে মাটিতে চাপ পড়লে বা কেউ হোঁচট খেলে হঠাৎ করে বিস্ফোরিত হয়, যার কারণে শিশু, কৃষক কিংবা সাধারণ পথচারীরাও হতাহত হন।
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির মতে, ক্লাস্টার বোমার ইতিহাস প্রায় এক শতাব্দী পুরোনো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এটির ব্যবহার শুরু হয়, কিন্তু শীতল যুদ্ধের সময় এ অস্ত্রের মজুত ও ব্যবহারে ব্যাপকতা দেখা যায়। উদ্দেশ্য ছিল শত্রুপক্ষের সৈন্যদের ছড়িয়ে থাকা ইউনিট বা ট্যাংক বাহিনী ধ্বংস করা।
২০০৮ সালে ‘ক্লাস্টার মিউনিশন কনভেনশন’ নামক এক আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে এই ধরণের অস্ত্র ব্যবহার, উৎপাদন, রপ্তানি ও সংরক্ষণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
এই কনভেনশনে এখন পর্যন্ত ১২৩টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ইসরায়েল এবং ইরানের মতো ক্ষমতাধর দেশগুলো এখনো এতে সই করেনি, যার ফলে এসব দেশের মধ্যে এই বোমার ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, “ক্লাস্টার বোমা যুদ্ধের সময় তাৎক্ষণিক সামরিক সুবিধা দিলেও যুদ্ধশেষে বেসামরিক মানুষের জীবনকে দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ রকম ক্ষতির মুখে ফেলে।
এখন পর্যন্ত ইরান সরকারিভাবে এই অভিযোগের কোনো উত্তর দেয়নি। ইরানের পক্ষ থেকে শুধু এটুকু বলা হয়েছে যে তারা “ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে।”
তবে নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, এই বিষয়ে ইরানি সেনাবাহিনী কিংবা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কেউ মুখ খোলেনি। এতে পরিস্থিতি আরও ধোঁয়াশা এবং উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই অভিযোগকে গভীরভাবে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছে। তারা বলছে, “বেসামরিক জনগণের ওপর ক্লাস্টার বোমার প্রভাব ভয়াবহ। এটা যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে।”
বিশ্বের অনেক দেশ ও সংস্থা ইতোমধ্যেই স্বতন্ত্র তদন্ত দাবি করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) ইস্যুটি নিয়ে অনুসন্ধান শুরুর কথা ভাবছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
ইরান-ইসরায়েলের চলমান সংঘাত কেবল দুই দেশের মধ্যকার নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বশান্তির জন্য এক গভীর হুমকি হয়ে উঠছে।
যদি সত্যিই ইরান ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার করে থাকে, তবে তা শুধু যুদ্ধের ভয়াবহতাই নয়, বরং মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন কূটনৈতিক উদ্যোগ, আন্তর্জাতিক তদন্ত এবং সবচেয়ে বড় কথা— মানবতার রক্ষা। যুদ্ধের ময়দান হোক যত বড়ই, তার চেয়ে বড় কখনোই নয় শিশুদের খেলার মাঠ, সাধারণ মানুষের ঘর কিংবা একটি জাতির ভবিষ্যৎ।