বর্ষায় কাদা, শুষ্ক মৌসুমে ধুলো: ফাইতং ইউনিয়নের মানুষের শেষ না হওয়া দুর্ভোগ..

Farhad Ahmad avatar   
Farhad Ahmad
****

বর্ষাকাল এলেই ফাইতং ইউনিয়নের মানুষের জীবন হয়ে ওঠে চরম দুর্বিষহ। ভাঙাচোরা সড়ক, অসংখ্য খানাখন্দ, দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা আর কাঁদা-পানির যন্ত্রণায় জনজীবন প্রায় অচল হয়ে পড়ে। কাদা মাড়িয়ে স্কুলে যেতে হয় শিশুদের, আর অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া যেন এক রীতিমতো যুদ্ধ। একদিকে সময় নষ্ট, অন্যদিকে জীবনঝুঁকি—দুটোই নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে বর্ষায়।

এই দুর্ভোগ কাটতে না কাটতেই যখন শুষ্ক মৌসুম আসে, তখন মানুষের কষ্টের রূপ বদলায় মাত্র—যন্ত্রণার গভীরতা কমে না একটুও। বরং নেমে আসে আরেকটি নীরব অথচ ভয়ংকর দুর্যোগ। তখন ফাইতং ইউনিয়নের আকাশ-বাতাস যেন ভারী দীর্ঘশ্বাসে ভরে ওঠে। চারপাশ ঢেকে যায় উড়ন্ত ধুলোবালির এক অদৃশ্য কারাগারে, যেখানে শ্বাস নেওয়াটাই হয়ে পড়ে কষ্টকর।
অপরিকল্পিত শিল্পায়নের নামে যত্রতত্র গড়ে ওঠা ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া, বছরের পর বছর ধরে চলাচল করা ভারী যানবাহন, বর্ষাকালে তৈরি হওয়া খানাখন্দ ও কাঁদার স্তুপ শুষ্ক মৌসুমে খোলা অবস্থায় পড়ে থাকে। এসব মাটি ও কাঁদা ভারী ট্রাক, ডাম্পার ও অন্যান্য যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রতিনিয়ত ধুলোবালিতে পরিণত হচ্ছে। অথচ ধুলো নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় পুরো ফাইতং ইউনিয়ন কার্যত ধুলোবালির রাজ্যে রূপ নিয়েছে।
প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ফাইতং–বানিয়ারছড়া, ফাইতং–শিবাতলী পাড়া, ফাইতং–ফাদুরছড়া, ফাইতং–লম্বাশিয়া পাড়া ও ফাইতং–রোয়াজা পাড়া সড়ক দিয়ে চলাচল করা ভারী যানবাহনের চাপে বাতাসে উড়তে থাকে লালচে ধুলোর ঘন মেঘ। এই ধুলো কেবল সড়কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না; তা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রাম-পাড়া, বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি স্তরে।


ফাইতং বাজার থেকে শুরু করে রোয়াজা পাড়া, ফাদুরছড়া, রাইম্যাখোলা, শিবাতলী পাড়া, লম্বাশিয়া পাড়া ও বানিয়ারছড়া সড়কের দুই পাশের পুরো এলাকা যেন স্থায়ীভাবে এক অদ্ভুত লালচে রঙ ধারণ করেছে। দিনের পর দিন উড়ন্ত ধুলো জমে এলাকার ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, কাপড়চোপড়, পানির কল, রান্নাঘর ও গাছপালায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, ধুলোবালিতে মানুষের জামাকাপড় দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বারবার ধুয়েও পরিষ্কার রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
আরও ভয়াবহ হলো—অনেক সময় ধুলোর ঘনত্ব এত বেশি থাকে যে সামনের রাস্তাঘাট পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায় না। এতে পথচারী ও যানবাহন চালকদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ছে, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও মোটরসাইকেল আরোহীদের ক্ষেত্রে।


এই ধুলোর প্রভাব কৃষিখাতেও মারাত্মক। কৃষিজমির ওপর ধুলোর পুরু আস্তরণ জমে ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। ফলের গাছের পাতা ঝরে পড়ছে, শাকসবজি নষ্ট হচ্ছে। কৃষকদের ভাষায়, এই ধুলো শুধু চলতি মৌসুমের ফসলই নষ্ট করছে না, ধীরে ধীরে তাদের ভবিষ্যৎ জীবিকাকেও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।


পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি এই ধুলোবালি নীরবে মানুষের শরীরেও ভয়াবহ আঘাত হানছে। স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের মতে, এলাকায় শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে হাঁপানি, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্কাইটিস, সাইনোসাইটিস ও অ্যালার্জিক রাইনাইটিসে। চোখে ধুলো ঢুকে সৃষ্টি হচ্ছে কনজাংকটিভাইটিস, চোখ জ্বালা ও অনবরত পানি পড়ার সমস্যা। ত্বকে দেখা দিচ্ছে চুলকানি, র‍্যাশ ও ডার্মাটাইটিস। শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে বারবার জ্বর, দুর্বলতা ও শ্বাসকষ্ট এখন নিত্যদিনের সঙ্গী।
সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো—এই ধুলোবালির ভেতরেই রয়েছে পিএম–১০ ও পিএম–২.৫-এর মতো অতি সূক্ষ্ম কণা, যা সহজেই মানুষের ফুসফুস ও রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি থেকে উৎপন্ন সিলিকা ধুলো, যানবাহনের ধোঁয়া থেকে নির্গত সিসা ও কার্বন কণা এবং ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ও নিকেলের মতো ভারী ধাতু। দীর্ঘদিন এসব উপাদান শরীরে জমে নিউমোনিয়া, সিওপিডি, সিলিকোসিসের মতো দুরারোগ্য ফুসফুসের রোগ, এমনকি ফুসফুস ক্যানসার, হৃদ্‌রোগ, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীদের জন্য এই ধুলোবালি হয়ে উঠেছে এক নীরব ঘাতক।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, একসময় অন্তত ধুলো নিয়ন্ত্রণে সড়কে নিয়মিত পানি ছিটানো হতো, এতে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও সহনীয় থাকত। কিন্তু বর্তমানে সেই সামান্য উদ্যোগটুকুও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ধুলোর ঘনত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে শ্বাস নেওয়াই যেন এক ধরনের সংগ্রামে পরিণত হয়।


আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো—এই ধুলোমাখা সড়কের পাশ দিয়েই অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, মসজিদ, গির্জা ও অসংখ্য বসতবাড়ি। স্কুলগামী শিশুরা প্রতিদিন ধুলোর ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ক্লাসে। নামাজ আদায় বা প্রার্থনায় অংশ নিতে আসা মানুষজনও বাধ্য হচ্ছেন স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েই চলাফেরা করতে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বৃদ্ধ—কেউই এই ঝুঁকি থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল মান্নান কণ্ঠ ভারী করে বলেন, “শুষ্ক মৌসুম এলেই আমাদের জীবন থমকে যায়। দরজা-জানালা বন্ধ রেখেও ধুলো আটকানো যায় না। বাচ্চারা হাঁপানি আর কাশিতে ভুগছে, ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে—কিন্তু আমাদের দিকে তাকানোর কেউ নেই।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, “আমাদের সন্তানেরা প্রতিদিন ধুলো গিলেই স্কুলে যাচ্ছে। পড়াশোনার পরিবেশ তো দূরের কথা, এখন সুস্থ থাকাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”


এলাকাবাসীর আরও অভিযোগ, উন্নয়নের নামে সুবিধা ভোগ করছে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী। তারা চার চাকার গাড়িতে ধুলো পেছনে ফেলে নিরাপদে চলে গেলেও ফাইতং ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ পড়ে থাকে ধুলো, রোগ আর অসহায়তার মাঝে। এই তথাকথিত উন্নয়ন যেন মানুষের জীবনের ওপর এক নীরব অথচ নিষ্ঠুর আঘাতে পরিণত হয়েছে।
ফাইতং ইউনিয়নের বাসিন্দারা অবিলম্বে সড়কে নিয়মিত পানি ছিটানো, ধুলো নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, ভারী যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ এবং পরিকল্পিত ও মানবিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ দাবি জানিয়েছেন। নইলে শুষ্ক মৌসুমের এই ধুলো শুধু পরিবেশ নয়—ধীরে ধীরে পুরো একটি জনপদকে ঠেলে দেবে ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকটের দিকে। এই আশঙ্কাই এখন ফাইতংয়ের মানুষের বুকভরা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।

No comments found


News Card Generator