close

ভিডিও আপলোড করুন পয়েন্ট জিতুন!

বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ফেরাতে বিডা-বেজা’র ‘ডাবল অ্যাটাক’..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ কেন একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য, সে বিষয়ে তিনি তিনটি মৌলিক সুবিধার কথা তুলে ধরেন:

..

গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরানো ও দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমূল কাঠামোগত সংস্কার শুরু করেছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। প্রতিষ্ঠান দুটির নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মোহাম্মদ বিন হারুন স্পষ্ট জানিয়েছেন, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ, বিশেষত লজিস্টিক সাপোর্টের সবচেয়ে বড় বাধা—বন্দরের দুর্নীতি—দূর করাই এখন প্রধান লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে, বন্দরের পরিচালন ব্যবস্থা বিশ্বমানের অপারেটরের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে এবং বিনিয়োগকারীদের সেবা সহজ করতে আসছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম 'বাংলাবিজ'।

দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ১২ সেপ্টেম্বর বিডা ও বেজা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন চৌধুরী আশিক মোহাম্মদ বিন হারুন। সম্প্রতি তিনি সিনিয়র সচিব থেকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা পান। নতুন সরকারের অধীনে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, "আমরা যেই গণঅভ্যুত্থানের পরে আমরা কিন্তু খুব দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে চলে এসেছি... অনেকেই চিন্তা করছিলেন যে আদৌ বাংলাদেশ কি আরেকটা নতুন ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেল কিনা, সেই ধারণাটা উনারা ধরে রাখেননি।"

তিনি মনে করেন, সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং একটি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির (Contractionary Monetary Policy) কারণে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দ্রুত ফিরে এসেছে। তিনি বিনিয়োগকারীদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে "দেখেন, আমরা দিস ইজ এ নিউ বাংলাদেশ, ইটস এ নিউ বিগিনিং"। তার মতে, এই ইতিবাচক বার্তা কাজ করেছে, যার ফলস্বরূপ এফডিআই (FDI) এর সংখ্যা ২০ শতাংশ পজিটিভ দিকে আছে।

বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের সবচেয়ে বড় বাধাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দুর্বল লজিস্টিক সাপোর্ট এবং বন্দরে বিদ্যমান দুর্নীতি। এই সমস্যার সমাধানে সরকার যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, তা বিডা প্রধানের কথায় পরিষ্কার।

চৌধুরী আশিক জানান, ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে পোর্টে যে পরিমাণ দুর্নীতির সম্মুখীন হন, তা একটি 'অন্য লেভেলের দুর্নীতি'। এই দুর্নীতি দূর করার জন্যই বিদেশী অপারেটর বা বৈশ্বিক স্ট্যান্ডার্ডের অপারেটরদের প্রয়োজন।

১. দুর্নীতি প্রতিরোধ: "আমার প্রথম মানদন্ড হচ্ছে যে আমি আসলে একটি দুর্নীতিমুক্ত লজিস্টিক সিস্টেম করতে চাই এবং সেটা করতে হলে আমাকে আসলে একদম গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডের অপারেটরকে আনতেই হবে।" এই অপারেটরদের বৈশ্বিক সুনাম তাদের কাছে এক টাকা এদিক-ওদিক করার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

২. দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ: চীন-এর মতো ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হতে হলে বাংলাদেশের "বেস্ট পোর্ট" প্রয়োজন। স্থানীয় অপারেটরদের বৈশ্বিক মানদণ্ডে খেলার অভিজ্ঞতা নেই। তিনি বলেন, বিদেশী অপারেটররা একজন গাড়ির ড্রাইভারের মতো, মালিক নয়।

"বিদেশী অপারেটররা কিন্তু পোর্ট নিয়ে চলে যাচ্ছে না। পোর্ট পোর্টের জায়গায় আছে, পোর্ট আমাদের আছে। ইট ইজ বেসিক্যালি আপনি আপনার গাড়িতে একজন ড্রাইভার নেন... আমিও একজন আমি আমার বেস্ট কোয়ালিটি ড্রাইভার চাই যাতে সে আমার গাড়িটা সবচেয়ে ভালোভাবে চালাতে পারে।"

তিনি আরও স্পষ্ট করেন যে প্রযুক্তিগত জ্ঞান (টেকনিক্যাল নো-হাউ) স্থানান্তরিত হয় ব্যবস্থাপনা স্তরে (Management Level), মালিকানা স্তরে নয়। বিদেশী অপারেটর এলে তাদের অধীনে কাজ করা দেশীয় কর্মীরা শিখবে এবং একসময় নিজেরাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করতে পারবে।

বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ কেন একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য, সে বিষয়ে তিনি তিনটি মৌলিক সুবিধার কথা তুলে ধরেন:

  • ১. ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ বাজার: ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম কনজিউমার মার্কেট হবে। এই তরুণ ও ইন্টারনেট-সংযুক্ত বাজার বৈশ্বিক মানদণ্ড বোঝে, যা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য ট্যাপ করা সহজ।

  • ২. তরুণ ও প্রশিক্ষণে সক্ষম জনশক্তি: আগামী ৫০ বছরেও শ্রমিক সরবরাহের অভাব হবে না, এমন নিশ্চয়তা এখন পৃথিবীতে খুব কম দেশই দিতে পারে। বাংলাদেশের এই ইয়াং, ট্রেইনেবল ওয়ার্কফোর্স একটি বিরল সম্পদ।

  • ৩. অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান: এশিয়া বিশ্বের প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন। বাংলাদেশ থেকে মাত্র চার ঘণ্টার ডিসট্যান্সে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ কোটি মানুষ বসবাস করে। লজিস্টিক সাপোর্ট উন্নত হলে এই অবস্থানটি খুব ইউনিক সুবিধা দেবে।

 

বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিন ধরে ভোগানো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও বহু এজেন্সিতে ঘোরার সমস্যা সমাধানে সরকার দুটি বড় কাঠামোগত পরিবর্তন আনছে:

 

১. বিডা ও বেজা’র সাংগঠনিক পুনর্গঠন

 

  • একীভূত পরিচালনা পর্ষদ: প্রথম আইনি পদক্ষেপ হিসেবে, বিডা, বেজা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা একটি সিঙ্গেল গভর্নিং বোর্ড-এর অধীনে চলে আসবে। এতে পুরো ব্যবস্থার একটি অভিন্ন চিত্র তৈরি হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবে।

  • ইনভেস্টর-জার্নিতে বিডা: বিডাকে এখন বিনিয়োগকারীর যাত্রা (Investor Journey) অনুযায়ী নতুন করে সাজানো হয়েছে। এখন বিডা একটি পোস্ট বক্সের মতো কাজ না করে, বিনিয়োগকারী কী চান তার ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছে—যেমন, ডিউ ডিলিজেন্সের জন্য রিসার্চ উইং, নির্দিষ্ট দেশের জন্য কান্ট্রি টিম এবং এনআরবি ডেস্ক।

 

২. ডিজিটাল সার্ভিস প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাবিজ’

 

বিনিয়োগকারীদের সরকারি সেবা প্রাপ্তি সহজ করতে সম্পূর্ণ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

  • ‘বাংলাবিজ’ (BanglaBiz): ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি প্রথম ধাপে এই প্ল্যাটফর্মটি রোল আউট করা হবে।

  • স্টারটার প্যাক: প্রাথমিক পর্যায়ে 'বাংলাবিজ'-এ একটি 'স্টারটার প্যাক' থাকবে। একজন নতুন ব্যবসায়ী যেন উইন্ডোজ ইনস্টল করার মতো একটি ফর্মে ট্রেড লাইসেন্স, ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ অন্তত পাঁচটি মৌলিক সেবা একসঙ্গে পেয়ে যান, সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

  • লক্ষ্য: বিডা প্রধানের প্রত্যাশা, যদি এই ট্র্যাক ধরে রাখা যায়, তবে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে বিনিয়োগকারীদের জন্য সরকারি সেবা শতভাগ ডিজিটাল ফর্মে চলে যাবে।

  • প্রাইভেট সেক্টর ক্রেডিট গ্রোথ: বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম হওয়াকে তিনি বিস্ময়কর মনে করেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি অনিশ্চয়তা (Sense of Uncertainty) এবং সরকার কর্তৃক কঠোর ব্যাংকিং খাতে সুশাসন (Governance) প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপকে দায়ী করেন। তার মতে, কঠোর মুদ্রানীতি এবং ঋণকে সঠিকভাবে ক্লাসিফায়েড করার কারণেই এই ধীরগতি। তবে, এই 'ল্যাগ' বা ধীরতা দেশের জন্য ভালো, কারণ এটি একটি শক্তিশালী ভিত্তি দেবে।

  • সামরিক শিল্পায়ন: জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থে সামরিক শিল্পায়ন (Military Industrialization) নিয়ে সরকারের কোনো সন্দেহ নেই। এই নীতি নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোরও ইতিবাচক সমর্থন রয়েছে বলে তিনি জানান।

  • বিনিয়োগ সম্মেলন: সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলন থেকে ১.৮ বিলিয়ন ডলারের একটি পাইপলাইন তৈরি হয়েছিল, যার মধ্যে রাফলি ৩০০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১৬%) বাস্তবে রূপ নেবে বলে আশা করা হচ্ছে। বৈশ্বিক মানদণ্ডে এটি একটি ভালো মেটেরিয়ালাইজেশন রেট।

 

বিডা ও বেজা প্রধানের বক্তব্যে এটি স্পষ্ট যে, বিদ্যমান কাঠামোগত দুর্বলতা ও দুর্নীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার কেবল নীতিমালা নয়, বরং পুরো পদ্ধতিগত সংস্কার নিয়ে এগোচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা দেখাতে বন্দর পরিচালনায় বৈশ্বিক মানদণ্ড আরোপ এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য ডিজিটাল গতি আনতে 'বাংলাবিজ'-এর মতো প্রকল্প হাতে নেওয়া—এই দুই উদ্যোগই বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ফেরানোর ক্ষেত্রে সরকারের গভীর আগ্রহকে প্রতিফলিত করে। তবে, এই উচ্চাভিলাষী সংস্কারগুলোর সফলতা নির্ভর করবে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন এবং দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। দেশের ব্যবসায়ী মহল এবং সাধারণ জনগণও এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, কবে এই ‘ডাবল অ্যাটাক’-এর ফলস্বরূপ বাংলাদেশে ব্যবসা করার জটিলতা বাস্তবে কমতে শুরু করবে।

نظری یافت نشد


News Card Generator