বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আজ যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবিতে উত্তাল রাজনীতি করছে, তার সত্যতা যাচাই করতে হলে সবার আগে বিএনপির জন্ম ও ক্ষমতার উত্থান কোথা থেকে এবং কীভাবে হয়েছে, সেটি পুনরালোচনার দরকার আছে। জাতির ইতিহাসে এটি কোনো সাধারণ দলীয় উত্থান ছিল না, বরং এটি ছিল এক সামরিক শাসকের হাত থেকে দল গঠনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের মুখোশ পরিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, তার সুযোগ নিয়েই জিয়াউর রহমান এক সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। এরপর চার বছর পর্যন্ত তিনি কোনো ধরনের নির্বাচনের মুখোমুখি না হয়ে, সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ করেন। এই চার বছর তিনি কীভাবে ক্ষমতায় ছিলেন, এবং কার কাছ থেকে এই ক্ষমতা লাভ করেছিলেন, এই প্রশ্ন আজও উত্তরবিহীন। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, দেশের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক চর্চা ছিল একপ্রকার নির্বাসনে।
এরই মধ্যে, জিয়াউর রহমান নিজেই দল গঠন করেন—বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তিনি ক্ষমতার অবস্থান থেকে এই দল গঠন করেন, এবং সেটাকে সাংগঠনিক রূপ দিয়ে গণতন্ত্রের লেবাসে উপস্থাপন করেন। পরে একটি নির্বাচন দেন, যেখানে তার দলেরই একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, তিনি যে চার বছর নির্বাচন ছাড়া রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, সেটি কি গণতন্ত্রের অনুশীলনের পরিপন্থী নয়? আজ যখন বিএনপি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবিতে আওয়াজ তোলে, তখন তাদের নিজের অতীত আচরণ কি তাদের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না?
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপির প্রতিটি বক্তব্যের কেন্দ্রে রয়েছে নির্বাচন। এমনকি দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা যেকোনো বিষয়ে কথা বলতে গিয়েও নির্বাচনকে সামনে নিয়ে আসেন। খাওয়ার টেবিলে বসেও 'নির্বাচন দিন', ঘুমাতে যাওয়ার আগে 'নির্বাচন দিন', টয়লেটেও তারা ভুলেন না এই বক্তব্য—এই একমাত্র স্লোগান যেন এখন দলের দেহে-মনে প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই কথাগুলো কি বাস্তব প্রয়োজনে বলা হচ্ছে, না কি কোনো বিদেশি শক্তির ইশারায়?
অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই কথাবার্তার পেছনে ভারতের একটি সুপরিকল্পিত প্রেসক্রিপশন কাজ করছে। ভারত বর্তমানে চায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ুক, যাতে ভারত তার কৌশলগত সুবিধা নিতে পারে। ভারত জানে, শেখ হাসিনা সরকার অনেক অপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ভোট কারচুপির অভিযোগে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে রয়েছে। এমন সময়ে ভারত কোনোভাবেই চায় না যে, শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত কোনো গণহত্যার দায় মোদী সরকার বা ভারতকে আন্তর্জাতিকভাবে অভিযুক্ত করে।
এই আশঙ্কা থেকেই ভারত কৌশলগতভাবে বিএনপির সঙ্গে এক প্রকার চুক্তিতে প্রবেশ করেছে। এই চুক্তির মূল কথা হচ্ছে—বিএনপি রাজনৈতিক চাপ তৈরি করবে, এমনভাবে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেবে, যাতে বর্তমান সরকার আরও চাপে পড়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে ভারত দুই দিকই সামলাবে—একদিকে আওয়ামী লীগ সরকারকে রক্ষা করবে, অন্যদিকে বিএনপিকেও নানাভাবে ব্যবহার করবে।
এছাড়া বিএনপি এমনভাবে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করছে যাতে দেশের জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, আন্তর্জাতিক মহলে সরকারের অবস্থান দুর্বল হয় এবং ভারত এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের কৌশলিক স্বার্থ পূরণ করে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের নদীগুলো নিয়ে ভারত দীর্ঘদিন ধরে আগ্রাসী নীতি নিয়ে চলেছে। তিস্তা, গঙ্গা ও অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন ইস্যুতে ভারতের একতরফা নীতি বাংলাদেশের জনগণের মাঝে ক্ষোভ তৈরি করেছে। এসব চুক্তি আড়ালে রাখার জন্য ভারত রাজনৈতিক উত্তেজনা টিকিয়ে রাখতে চায়।
এখন প্রশ্ন ওঠে—বিএনপি কি একমাত্র ভারতীয় চক্রান্তে ব্যবহৃত হচ্ছে? তাদের নিজের অবস্থান কি এতটাই দুর্বল যে, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার ক্ষমতাও তাদের নেই? বিএনপির অভ্যন্তরে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও দখলদারিত্ব এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে, সাধারণ জনগণের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আজ ন্যূনতম পর্যায়ে।
বিএনপির নেতারা বিভিন্ন সময়ে সরকারি সম্পত্তি, বাসস্ট্যান্ড, মার্কেট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি ধর্মীয় স্থানের জমিও দখল করে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের অনেক নেতা অসংখ্য দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত, যেগুলোর প্রমাণ আদালতে দাখিলও হয়েছে। আজ যারা একবাক্যে 'গণতন্ত্র চাই', 'নির্বাচন চাই' বলে চিৎকার করছেন, তারাই কি একসময় জনগণের কণ্ঠ রোধ করেননি? তারাই কি দুর্নীতির মধ্য দিয়ে দলীয় রাজনীতিকে কলুষিত করেননি?
বিএনপির অপরাধনীতিকে আরও ভয়ংকর করেছে তাদের উগ্র বক্তব্য ও রাজনৈতিক হিংসা। দলটি নানা সময়ে যেসব নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে, তা শুধু রাষ্ট্র নয়, সমাজকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আগুন-সন্ত্রাস, পুলিশের ওপর হামলা, জনজীবনে বিঘ্ন সৃষ্টি—এসব কার্যকলাপ তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে সন্দেহের চোখে দেখতে বাধ্য করেছে।
শুধু বিএনপি নয়, আরও কিছু রাজনৈতিক দলও আজ ভারতীয় প্রেসক্রিপশনে পরিচালিত হচ্ছে। ইসলামপন্থি দলগুলো, বাম রাজনীতি, এমনকি কিছু তরুণ সংগঠনও আজ ভারতের খোলসে নিজেদের মুখ লুকিয়ে কাজ করছে। এদের উদ্দেশ্য একটাই—দেশের মধ্যে এমন অস্থিরতা সৃষ্টি করা, যাতে আন্তর্জাতিকভাবে ভারত দোষমুক্ত থাকে এবং তার কৌশলিক স্বার্থে বাংলাদেশ সব সময় নির্ভরশীল থাকে।
আওয়ামী লীগ সরকারও নির্দোষ নয়। তাদের শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যার অভিযোগ, ভোটাধিকার হরণ—এসব বিষয় বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে বিব্রত করেছে। ভারত এসব পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে। ভারতের চাপেই অনেক সময় বাংলাদেশ নতজানু অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু এসব অপকর্মের দায় কি শুধু আওয়ামী লীগের? যারা এক সময় দেশের নেতৃত্বে ছিল, তারাও কি এই অপকর্মের অংশীদার ছিল না?
অতএব, আজ যখন বিএনপি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আওয়াজ তোলে, তখন জনগণ সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন তোলে—তাদের দাবি কি জনগণের জন্য, না কি ভারতের চুক্তিপত্র বাস্তবায়নের জন্য?
বিএনপির নেতারা যদি সত্যিই নির্বাচন চান, তাহলে আগে তাদের নিজেদের দলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দুর্নীতি-বিরোধী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
জনগণের আস্থা ছাড়া কোন নির্বাচনই টেকসই হবে না। জনগণ আজ আর শুধু ‘নির্বাচন চাই’ শুনে আন্দোলনে নামে না, বরং দেখে কে নির্বাচন চায় এবং কেন চায়।
আজকের এই প্রবন্ধ সেই কঠিন প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্যই রচিত, যেখানে রাজনীতি আর ভণ্ডামি একসঙ্গে মিশে গেছে। এই রাজনৈতিক অসারতা দূর করতে হলে, বিএনপিকে তার কৃতকর্মের জবাব দিতে হবে এবং ভারতসহ অন্য দেশের স্বার্থরক্ষাকারী ভূমিকা থেকে সরে এসে একটি স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাশীল রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
এই বিশ্লেষণ একটি দলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর উদ্দেশ্যে নয়, বরং জনগণের সামনে সত্য তুলে ধরার প্রয়াস। বাংলাদেশ কারো প্রেসক্রিপশনে চলবে না—এটাই হওয়া উচিত আজকের অঙ্গীকার।