অভিনয় থেকে বিদায়? মৌসুমীর মর্মস্পর্শী স্বীকারোক্তি—‘ভুলে যেতে চাই আমি মৌসুমী ছিলাম!’
ঢাকাই সিনেমার এক সময়ের সর্বাধিক জনপ্রিয় ও সম্মানিত অভিনেত্রী ‘প্রিয়দর্শিনী’ মৌসুমী আজ যেন শুধুই অতীতের নাম। দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনার বাইরে থাকা এই চিত্রনায়িকা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন, আর সেখানেই ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন সব ধরনের অভিনয় ও মিডিয়া কার্যক্রম থেকে।
মৌসুমীর স্বামী ও সুপরিচিত অভিনেতা ওমর সানী সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, মৌসুমী হয়তো আর কখনোই অভিনয়ে ফিরছেন না। নিউ জার্সিতে বর্তমানে মেয়ে ও মায়ের সঙ্গে বসবাস করছেন তিনি। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকেই সেখানে আছেন এই অভিনেত্রী। মেয়ের উচ্চশিক্ষা ও শাশুড়ির শারীরিক অসুস্থতা—সবকিছু মিলিয়ে পরিবারই এখন তার জীবনের একমাত্র অগ্রাধিকার।
ওমর সানী বলেন, “মৌসুমী এখনই দেশে ফিরছে না। ও মেয়েকে সময় দিচ্ছে, আর মায়ের অসুস্থতা নিয়েই ব্যস্ত। আর ওর কথাতেই আমি কষ্ট পেয়েছি—ও বলেছে, ‘সে ভুলে যেতে চায়, কোনোদিন মৌসুমী ছিল।’ এই কথাটাই মনে হয় সবচেয়ে বেশি বেদনার।”
এই একটি বাক্যেই যেন ঝরে পড়ে দীর্ঘ অভিনয়জীবনের ক্লান্তি, ক্ষোভ ও নিরাশার প্রতিচ্ছবি। মৌসুমীর মতো একজন প্রতিভাবান ও কিংবদন্তী অভিনেত্রী যখন নিজেকে ভুলে যাওয়ার কথা বলেন, তখন বুঝতে বাকি থাকে না—দেশের মিডিয়া ও চলচ্চিত্রাঙ্গনে তাকে ঘিরে আর কোনো পরিকল্পনা নেই।
ওমর সানী আরও বলেন, “তার মতো একজন লিজেন্ডকে নিয়ে ভালো কোনো কাজ করার চিন্তাও কেউ করে না। নতুন প্রজন্মের অনেকেই নিজেদের মৌসুমীর চেয়েও বড় মনে করে—এটাও আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির বাস্তবতা।”
এমন কথার পেছনে এক বিষণ্ন বাস্তবতা লুকিয়ে আছে। এক সময় যিনি ছিলেন ঢালিউডের প্রাণ, আজ তিনিই চাইছেন যেন কেউ তাকে আর চেনে না, দেখে না।
মিডিয়া থেকে বিদায়ের আভাস আগেও দিয়েছিলেন
এটাই প্রথমবার নয়, এর আগেও একাধিক সাক্ষাৎকারে মিডিয়াকে বিদায় জানানোর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মৌসুমী। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি যদি মরে যাই, আমার সব ভুলের জন্য সবাইকে ক্ষমা চাই। আমি চাই না, আমার মৃত্যুতে কেউ আমার লাশ দেখুক। যেন সিক্রেটলি কবর দেয়া হয়। জানাজা হবে ঠিকই, কিন্তু যেন আমাকে আর কেউ দেখে না।”
এই কথাগুলো শুধু বিদায় নয়, এক গভীর মানসিক ক্লান্তির বহিঃপ্রকাশও বটে। নিজের মৃত্যু নিয়ে এমন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা সাধারণত একজন আত্মিকভাবে ক্লান্ত মানুষই করে থাকেন।
হজের ইচ্ছা ও শেষ অনুরোধ
মৃত্যুর আগে পবিত্র হজ পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন মৌসুমী। তিনি বলেন, “আমি মারা যাবার আগে বড় হজ করতে চাই। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন যেন আমি হজ করতে পারি।”
এছাড়াও নিজের অভিনীত চলচ্চিত্রগুলো নিয়েও নিজের একান্ত ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তার ভাষায়, “আমি চাই না মৃত্যুর পর টিভিতে আমার ধুমধাড়াক্কা সিনেমা চলে। সেগুলো যেন মুছে ফেলা হয়। যদি কেউ সংরক্ষণ করতে চায়, তবে ‘মৌসুমী আর্কাইভ’ নামে আলাদা স্থানে রাখবে। গবেষণার কাজে যদি লাগে, তবেই সেই ছবিগুলো রাখা হবে, নয়তো সব ডিলিট করে দেয়া হোক।”
ঢাকাই সিনেমার এক যুগের নাম—মৌসুমী
১৯৯৩ সালে প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ’র সঙ্গে 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত' সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় মৌসুমীর। এরপর একের পর এক সুপারহিট সিনেমায় কাজ করে তিনি হয়ে উঠেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সফল এবং জনপ্রিয় অভিনেত্রীদের একজন।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা। কিন্তু এখন তিনি আর সব কিছুর বাইরে, পারিবারিক শান্তিতেই খুঁজে পেয়েছেন নিজের নতুন জীবন।
সংক্ষেপে মৌসুমী প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টসমূহ:
-
বর্তমানে নিউ জার্সিতে মেয়ে ও মায়ের সঙ্গে বসবাস করছেন।
-
অভিনয়ে ফেরার কোনো পরিকল্পনা নেই।
-
মিডিয়া ও পুরনো সিনেমা থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলতে চান।
-
মৃত্যুর পর সব ছবি মুছে ফেলার অনুরোধ।
-
হজ পালন করে মৃত্যুবরণ করার ইচ্ছা।
-
নিজের পরিচয় ‘মৌসুমী’ হিসেবে ভুলে যেতে চান।
এক সময়ের গ্ল্যামার আর জনপ্রিয়তার পেছনে থাকা মৌসুমী আজ এক নিঃশব্দ প্রস্থান চান। চিরায়ত এক তারকার এমন বিদায় আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সেলিব্রিটি জীবন বাইরে থেকে যতই ঝলমলে দেখাক, ভেতরে ভেতরে তারা হয়তো খুব নিঃসঙ্গ এক পথের যাত্রী।