বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করছে ভারত। সর্বশেষ ১৪ জুন এক নতুন বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ভারত স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে ৯টি পণ্যের আমদানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কার্যত তৃতীয় দফার এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের রপ্তানিতে বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে। ইতোমধ্যেই এতে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছে দেশের ১১৭টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, যারা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বাজারে পণ্য সরবরাহ করে আসছিল।
নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় রয়েছে প্রধানত পাটশিল্প সংশ্লিষ্ট পণ্য। এতে আছে:
-
কাঁচা পাট
-
পাটের সুতা
-
ফ্ল্যাক্স সুতা
-
ফুড গ্রেড সুতা
-
পাটের রোল
-
লিনেন কাপড়
-
তুলা-মিশ্রিত কাপড়
-
কম প্রক্রিয়াজাত বোনা কাপড়
-
ফ্ল্যাক্স সুতার বর্জ্য
এই ৯টি পণ্যের মধ্যে প্রায় ৭টি-ই সরাসরি বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত পাটশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে পাটশিল্প আজ সবচেয়ে বড় আঘাতের মুখে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে এই ৯টি পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৬৬ কোটি ডলারের, যার মধ্যে প্রায় ১৫ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য ভারতে গেছে— অর্থাৎ এই ৯ পণ্যের ২৩% রপ্তানি শুধু ভারতে হয়েছিল। ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞা একাই এই রপ্তানিকে অচল করে দিয়েছে।
এর আগে ১৭ মে প্রথম দফায় ভারত স্থলপথে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ফলের রস ও কোমল পানীয়সহ একাধিক পণ্যে বিধিনিষেধ দেয়, যার আর্থিক প্রভাব ছিল প্রায় ৫০ কোটি ডলার।
দ্বিতীয় দফায় ৯ এপ্রিল ভারতের কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশি পণ্য বিদেশে পাঠানোর সুবিধা বাতিল করে দেওয়া হয়।
সর্বশেষ তৃতীয় দফা নিষেধাজ্ঞার ফলে এখন পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৪০% বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
ভারতে রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠান শীর্ষে রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম:
-
পপুলার জুট এক্সচেঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ):
-
ভারতেই রপ্তানি করেছে ১ কোটি ১৬ লাখ ডলার, যা তাদের মোট রপ্তানির ৫০%।
-
সবমিলিয়ে তাদের বার্ষিক রপ্তানি: ২ কোটি ৩২ লাখ ডলার।
-
-
জনতা জুট মিলস (নরসিংদী):
-
ভারত রপ্তানি: ১ কোটি ৩ লাখ ডলার, যা তাদের মোট রপ্তানির ১৩%।
-
প্রতিষ্ঠানটি আকিজ বশির গ্রুপের মালিকানাধীন।
-
সবমিলিয়ে ১১৭টি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ভারতীয় নিষেধাজ্ঞায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভারতের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ পণ্যগুলো সমুদ্রপথে মুম্বাইয়ের নভোসেবা বন্দর দিয়ে আমদানি করা যাবে।
তবে সমস্যাটা এখানেই—বাংলাদেশ থেকে এসব পণ্যের মাত্র ১% রপ্তানি হয় সমুদ্রপথে।
এ ছাড়া, সমুদ্রপথে পণ্য পাঠানো যেমন সময়সাপেক্ষ, তেমনি খরচও কয়েক গুণ বেশি। মুম্বাই বন্দর থেকে পশ্চিমবঙ্গ বা অভ্যন্তরীণ ভারতের গন্তব্যে পণ্য পৌঁছাতে সময় ও পরিবহন ব্যয় মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। ফলে রপ্তানিকারকদের লাভজনক বাজার কার্যত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
তাপস প্রামাণিক, সভাপতি, বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) জানান:এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি রাজনৈতিক। এতে বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানি ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কতটা প্রভাব পড়বে, তা বিশ্লেষণের জন্য আমরা ৩০ জুন বিজেএসএর বৈঠক ডেকেছি। এরপর আমরা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করব।
তাঁর মতে, সরকারের উচিত ভারতের সঙ্গে এই বিষয়ে কঠোরভাবে আলোচনা ও আপত্তি জানানো। কারণ, পাটশিল্প শুধু রপ্তানি আয় নয়, লাখ লাখ শ্রমিকের জীবিকার বিষয়।
সরকার যদি দ্রুত ও কূটনৈতিকভাবে এই সংকট মোকাবিলা না করে, তাহলে:
-
দেশের পাটশিল্প ধসে পড়তে পারে
-
বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে
-
রপ্তানি আয় ভয়াবহভাবে হ্রাস পাবে
-
হাজারো শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে, বিশেষ করে পাটপণ্যের বিকল্প রপ্তানি গন্তব্য খুঁজে বের করতে হবে এবং সমুদ্রপথে রপ্তানির সুবিধা সহজ করতে হবে।
ভারতের একের পর এক অশুল্ক বিধিনিষেধের ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখন চরম ঝুঁকিতে। স্থলপথ বন্ধ হওয়া মানে রপ্তানিকারকদের জন্য সোজা পথে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া।
সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি কূটনৈতিক পদক্ষেপ ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পাট খাতের এই সংকট নিরসনে এখন সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্তই একমাত্র উপায়।