ভারতের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি, সামনে কি অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য?
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছয়টি রাজ্য—অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম, সিকিম এবং ত্রিপুরা—এই মুহূর্তে ভয়াবহ এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিনের অবিরাম ভারী বর্ষণ এবং সেইসঙ্গে পাহাড়ি ঢলের কারণে অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বন্যা। নদ-নদীর পানি দ্রুত বেড়ে গিয়ে প্লাবিত করেছে গ্রাম ও শহরাঞ্চল। বেশ কয়েক জায়গায় সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ভূমিধসে ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে, বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
এই সংকট শুধু ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়—বাংলাদেশের জন্যও এটি এক বড় ধরনের অশনিসঙ্কেত। ভৌগোলিক বাস্তবতায় ভারতের এই ছয় রাজ্যের অনেক নদী ও পাহাড়ি জলপ্রবাহের শেষ গন্তব্য বাংলাদেশ। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীগুলো ভারতের উজান থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়। ফলে উজানে যদি অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ঢল নামে, তার ধাক্কা সরাসরি এসে লাগে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর ওপর।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কি ঘটতে যাচ্ছে?
পূর্বের বহু ঘটনা এ ধরনের সংকটের সতর্কতা হিসেবে কাজ করে। ১৯৮৮ সালের সেই স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা এখনও দেশের মানুষের মনে গাঁথা। ঢাকাসহ দেশের দুই-তৃতীয়াংশ ডুবে গিয়েছিল পানির নিচে। এর মূল কারণ ছিল ভারতের উত্তরাঞ্চলে অতিবৃষ্টি এবং হঠাৎ পানি ছেড়ে দেওয়া। ঠিক এমন একটি দৃশ্য আবারও ফিরে আসে ২০০৪ সালে, যখন মেঘালয়ে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাতের ফলে সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
সাম্প্রতিক বছর ২০২২ সালেও এই চিত্র পাল্টায়নি। মেঘালয় অঞ্চলের টানা ভারী বর্ষণের ফলে সিলেট ও সুনামগঞ্জে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হতে হয়। হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারায়, স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায়, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
এই মুহূর্তে ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
ভারতের সিকিম ও আসামে বর্তমানে যে পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে এবং নদীগুলোর পানির উচ্চতা যে হারে বাড়ছে, তাতে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চল বড় ধরনের বন্যার মুখে পড়তে পারে। বিশেষ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, নেত্রকোনা এবং ব্রহ্মপুত্র নদ তীরবর্তী এলাকাগুলো এখনো মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো, ভারত হঠাৎ করে কোনো ব্যারাজ বা জলাধারের গেট খুলে দিলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নদীগুলোর পানি মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বিপজ্জনক হারে বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে ভেসে যেতে পারে কৃষি জমি, প্লাবিত হতে পারে জনপদ, দেখা দিতে পারে খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ও ওষুধ সংকট। শিশু, বৃদ্ধ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন।
বিশেষজ্ঞদের বার্তা: প্রস্তুতির সময় এখনই
জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন—এখন আর দেরির সুযোগ নেই। প্রস্তুতি শুরু করতে হবে অবিলম্বে। সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ড, আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা, শুকনো খাবার ও পানীয় জলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল রাখা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা—এসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে—সাধারণ মানুষকে সময়মতো সতর্ক করে দেওয়া এবং সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়া, যাতে তারা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারেন।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে দায়িত্বশীল হতে হবে সবাইকে
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চলমান বন্যা পরিস্থিতি শুধুমাত্র দেশটির অভ্যন্তরীন দুর্যোগ নয়—এর ছায়া বাংলাদেশেও পড়ছে, পড়বে আরও গভীরভাবে। অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, এ ধরনের বন্যা শুধু প্রাণ ও সম্পদহানিই ঘটায় না, একটি অঞ্চলের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে ফেলে দেয়। এখনই সময়—প্রস্তুতি নেওয়ার, সম্মিলিতভাবে ঝুঁকি মোকাবিলা করার। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আটকানো না গেলেও, ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব—যদি আমরা আগেভাগে সচেতন হই।
 'আই নিউজ বিডি' অ্যাপ
  'আই নিউজ বিডি' অ্যাপ
  
  
 
		 
				 
			



















 
					     
			 
						 
			 
			 
			 
			 
			 
			