ভালোবাসার শেষ নিঃশ্বাস: স্ত্রীর যন্ত্রণায় স্তব্ধ স্বামী, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে চলে গেলেন দুজনেই
সুমন হাওলাদার
> “ভালোবাসা মানে কেবল একসঙ্গে বাঁচা নয়, একসঙ্গে মরতেও প্রস্তুত থাকা।”
— পটুয়াখালীর ভয়াং তুলাতলার জানাজা ময়দানে ফিসফিসে উচ্চারিত হয় এ কথাগুলো।
৬০ বছরের দাম্পত্যের পরিণতি এমন হবে—কে জানত? একসঙ্গে পথচলার শুরু ষাটের দশকে, আর সমাপ্তি ২০২৫ সালের ২১ এপ্রিল, এক অনন্য প্রেমগাথায়।
সাকেরা বেগম ও দেন আলী শিকদার—মির্জাগঞ্জ উপজেলার তুলাতলার এক অখ্যাত গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের ভালোবাসা আজ বিখ্যাত, কারণ তা হার মানিয়েছে সময়কেও।
সাকেরা বেগম দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ঢাকার সখিপুরে মর্ডান হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, রাখা হয় অক্সিজেন সাপোর্টে। যখন খবরটি দেন আলীর কানে পৌঁছায়, মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যান তিনি। প্রিয়তমার যন্ত্রণার ভার হয়তো সহ্য করতে পারেননি। ঘটনার আকস্মিকতায় স্ট্রোক করেন দেন আলী শিকদার।
তাঁকে দ্রুত বরিশাল শহরের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে কর্মরতরা তাঁর শারীরিক অবস্থা দেখে পরামর্শ দেন—তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য কোনো বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
পরিবার তাঁর চিকিৎসার জন্য আরেকটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সময় ততক্ষণে শেষ। হঠাৎ করেই, বরিশাল প্রাইভেট ক্লিনিকের গেটের সামনেই, চিকিৎসা শুরুর আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দেন আলী শিকদার।
এদিকে, সাকেরা বেগম তখনো জানতেন না, তাঁর জীবনসঙ্গী তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। রাত ৪টার দিকে তাঁকে গ্রামে আনা হয়, কিন্তু প্রিয়জনের শূন্যতায় ভোর ৭টায় সাকেরাও বিদায় নেন পৃথিবী থেকে।
দুজনের একসঙ্গে দাফন, জানাজায় হৃদয়বিদারক দৃশ্য
প্রথমে স্বামীর জানাজার প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু স্ত্রীরও চলে যাওয়ায় পরিবারের সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়—দুজনকেই একসঙ্গে দাফন করার সিদ্ধান্ত হয়। সকাল ১১টায় তাঁদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় নিজ বাড়ির পাশেই। পাশাপাশি দুটি কবর হয়ে ওঠে চিরকালের ভালোবাসার প্রতীক।
শত শত মানুষ হাজির ছিলেন সেই জানাজায়। নীরব চোখের জলে, কেউ কেউ পাথরবৎ দাঁড়িয়ে থেকে মেনে নিচ্ছিলেন এক কঠিন সত্য—এটা কোনো সাধারণ মৃত্যু নয়, এটা প্রেমের অনন্ত কাব্য।
ভালোবাসা, যা জীবনকে ছাড়িয়ে যায়
তাঁদের রেখে যাওয়া সন্তানরাও আজ অবধি বিশ্বাস করতে পারছেন না, কীভাবে দুজন মানুষ একই দিনে চলে যেতে পারেন—একজন হাসপাতালে, আরেকজন হাসপাতালের গেটে।
কিন্তু হয়তো এই বিদায় ছিল তাঁদের অদৃশ্য কোনো চুক্তি। ভালোবাসার চুক্তি। একসঙ্গে বাঁচার মতোই, একসঙ্গে মরারও।
এই গল্প শুধু একটি দম্পতির মৃত্যুর খবর নয়। এটি একটি সময়কে অতিক্রম করা ভালোবাসার ঘোষণা।
এটি সেই সত্য, যা প্রমাণ করে—ভালোবাসা কখনো মরে না। ভালোবাসা মৃত্যু ভুলিয়ে দিতে পারে।