অভিযুক্ত আবদুস শুক্কুর একজন গ্রাম পুলিশ। তার নিজ পিতা আব্দুর রাজ্জাকও একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু সে তার চাচা মৃত মুক্তিযোদ্ধা বসু মিয়াকে নিজের বাবা পরিচয় দিয়ে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরি করে এবং সেই পরিচয়ে মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা আত্মসাৎ করে আসছে ২০১৫ সাল থেকে।
শুধু একা নয়, এই প্রতারণায় যুক্ত ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের সচিব বখতিয়ার উদ্দিন, ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজন। এমনকি স্থানীয় নির্বাচন অফিসের কিছু অসাধু কর্মচারীর সহযোগিতায় শুক্কুর দ্বিতীয় এনআইডি সংগ্রহ করে। এর বিনিময়ে নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তার ভাই ও স্থানীয় এক চিকিৎসক শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়ার সঙ্গে ৫০ হাজার টাকার চুক্তি হয়।
মুক্তিযোদ্ধা ভাতার জন্য জালিয়াতি: কীভাবে কাজ করেছে?
২০০৮ সালে আবদুস শুক্কুর নিজের নামে একটি এনআইডি পান। পরে ২০১৪ সালে নতুন আরেকটি এনআইডি তৈরি করেন, যেখানে চাচাকে বাবা হিসেবে দেখান। এই ভুয়া পরিচয়ের ভিত্তিতেই ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ারিশ সনদ তৈরি করা হয়, যা তার মুক্তিযোদ্ধা বাবার পরিচয়কে বৈধতা দেয়। ২০১৫ সাল থেকে নিয়মিতভাবে সে বসু মিয়ার নামে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তুলছে, যা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ একাধিক ব্যক্তি ভাগাভাগি করে নিতেন।
প্রকাশ্যে আসার পর দায় এড়ানোর চেষ্টা
ঘটনার বিষয়ে আবদুস শুক্কুর স্বীকার করেছেন যে, তিনি ভুয়া এনআইডির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উত্তোলন করেছেন এবং নিয়মিত মাসোয়ারা দিতেন। তবে এই ঘটনায় জড়িত অন্যরা নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
ইউনিয়ন পরিষদের সচিব বখতিয়ার উদ্দিন বলেন, তিনি এনআইডি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত নন, তবে তার স্বাক্ষরে নতুন একটি প্রত্যয়নপত্র ইস্যু করা হয়েছে।
ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. ইলিয়াছ বলেছেন, তিনি ২০২১ সালে দায়িত্ব নিয়েছেন, তাই বসু মিয়ার বিষয়টি তার জানা নেই।
পল্লী চিকিৎসক শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া, যিনি এনআইডি তৈরির মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত, তিনি বলেছেন, শুক্কুর তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছেন।
প্রশাসনের তদন্ত ও ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি
এই ঘটনা প্রকাশের পর উপজেলা নির্বাচন অফিস কর্তৃক শুক্কুরের দুইটি এনআইডি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রশ্ন থেকে যায়: কতজন মুক্তিযোদ্ধার ভাতা এইভাবে লুটপাট হচ্ছে?
এই একটি ঘটনা প্রকাশ পেলেও, এরকম আরও কত প্রতারণা হচ্ছে তা এখনো অজানা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধা ভাতা আত্মসাতের ঘটনা নিয়মিত শোনা যায়। প্রশ্ন হলো, সরকারি পর্যায়ের তদারকি কোথায়? কীভাবে একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পরিচয় পাল্টে দেওয়া হলো? আর কতজন মুক্তিযোদ্ধার ত্যাগের বিনিময়ে অন্যরা আর্থিক সুবিধা ভোগ করছে?
এই ঘটনা বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ দেয়। এখন দেখার বিষয়, প্রশাসন কতটা কঠোর ব্যবস্থা নেয় এবং আদৌ এই ধরনের অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হয় কিনা।