বাংলাদেশের বিনোদন অঙ্গনে নারী তারকাদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত আক্রমণ নতুন কিছু নয়। এবার সেই কুরুচিপূর্ণ মানসিকতার শিকার হলেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। তিনি সম্প্রতি এক অনলাইন মন্তব্যকারীকে প্রকাশ্যে তুলে ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, যে তাকে "পতিতা" বলে আক্রমণ করেছিল।
এ ঘটনাটি কেবল একজন তারকার প্রতি করা একটি অপমানজনক মন্তব্য নয়, বরং আমাদের সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা একটি বড় সমস্যার প্রতিচ্ছবি। এই ঘটনার বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে নারীরা অবিচার, অবমাননা ও অনলাইন হেনস্তার শিকার হচ্ছেন, এবং এর বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিক্রিয়া কতটা জরুরি।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নারী তারকাদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য প্রায়ই দেখা যায়। অভিনেত্রী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ বা সমাজকর্মী—যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন, নারীরা অনলাইনে অপমানজনক মন্তব্যের সম্মুখীন হন। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, যেখানে পরিচয় গোপন রেখে যে কেউ যে কাউকে আক্রমণ করতে পারে, সেখানে নারীরা আরও বেশি বিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন।
শবনম ফারিয়ার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগে অভিনেত্রী পরীমণি, মিথিলা, অপু বিশ্বাসসহ অনেক তারকাই অনলাইন হেনস্তার শিকার হয়েছেন। অনেকে মুখ বুজে সহ্য করেন, অনেকে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেন।
শবনম ফারিয়া সাধারণত সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ সক্রিয় এবং সাহসী মতামতের জন্য পরিচিত। কিন্তু এবার তিনি নিজেই একটি অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখে পড়েছেন।
তিনি যেভাবে বিষয়টি সামনে এনেছেন, তা কেবল একজন নারীর আত্মসম্মান রক্ষার লড়াই নয়, বরং আমাদের সামাজিক কাঠামোর অসুস্থ দিকগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। তিনি যুক্তি দেখিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন:
- কিভাবে বিনোদন জগতে কাজ করা মানেই যৌনকর্মী হওয়া বলে ধরে নেওয়া হয়?
- নারীদের প্রতি এমন বিদ্বেষের কারণ কী?
- কীভাবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সম্ভব?
তার বক্তব্যে আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তিনি অনলাইন ট্রল বা হেনস্তাকারী ব্যক্তির কর্মস্থলের পরিচয় প্রকাশ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে এই ব্যক্তি ‘SAJIDA Foundation’-এ কাজ করেন, যা একটি এনজিও। সাধারণত এনজিওগুলোকে উদারপন্থী এবং মানবাধিকার-সমর্থক বলে ভাবা হয়। অথচ এমন একটি প্রতিষ্ঠান থেকে কাজ করা ব্যক্তি যদি এ ধরনের নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করেন, তাহলে তা সমাজের নৈতিক অবক্ষয়েরই প্রমাণ।
শবনম ফারিয়ার ঘটনাটি আমাদের সমাজে নারীদের প্রতি বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গির গভীর সংকটকে তুলে ধরে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদেরকে অবমূল্যায়ন ও অসম্মান করার প্রবণতা দীর্ঘদিনের।
- নারীর পোশাক, পেশা ও ব্যক্তিগত জীবন সবসময় বিশ্লেষণের শিকার হয়।
- সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচয় গোপন রেখে নারীদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো যেন সহজ হয়ে গেছে।
- নারী তারকাদের প্রতি বিদ্বেষ শুধু তাদের পেশার কারণে নয়, বরং সমাজে নারীদের অবস্থান দুর্বল রাখার একটি কৌশল।
এ থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার।
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকলেও, অনলাইন হয়রানির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উদাসীনতা দেখা যায়। যদিও এই আইন অনেকসময় রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহারের অভিযোগ পায়, তবে ব্যক্তিগতভাবে সাইবার হেনস্তার বিরুদ্ধে এটি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে কিছুটা হলেও সমাধান সম্ভব।
এক্ষেত্রে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর দায়িত্বও কম নয়। ফেসবুক, ইউটিউব বা টিকটক প্ল্যাটফর্মগুলোতে নারী বিদ্বেষী মন্তব্যের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
শবনম ফারিয়ার এই প্রতিবাদ শুধুমাত্র একজন তারকার আত্মসম্মানের লড়াই নয়, এটি আমাদের সমাজে নারীদের প্রতি চলমান অবমাননার বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। এ ধরনের ঘটনা কেবল নিন্দা বা সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়, বরং আমাদের শিক্ষা, নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তনের দিকে নজর দিতে হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি শবনম ফারিয়াদের সমর্থন দিতে প্রস্তুত, নাকি এমন বিদ্বেষকে আরও প্রশ্রয় দিতে থাকব?