close

লাইক দিন পয়েন্ট জিতুন!

আওয়ামী লীগ শেষ ৭১ নিয়ে, NCP শেষ ২৪ নিয়ে

Abdullah Al Mamun avatar   
Abdullah Al Mamun
৭১-এর কৃতিত্ব এককভাবে দাবি করে আওয়ামী লীগ যেমন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তেমনি ২৪-এর আন্দোলনের গৌরব একা দাবি করে NCP-ও হাঁটছে আত্মবিনাশের পথে। ইতিহাস কখনো একার নয়—এটা সব সময়ই জনতার।..

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিহাসের কৃতিত্ব নিজের ঝুলিতে পুরে ফেলার অসুস্থ প্রতিযোগিতা যেন একটি চিরন্তন প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এই দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেমন প্রতিনিয়ত দলীয় ব্যাখ্যায় বদলে যায়, তেমনি নতুন প্রজন্মের গণআন্দোলনের সাফল্যও এখন দাবি করা হচ্ছে একক কৃতিত্ব হিসেবে।

একদিকে আওয়ামী লীগ, যারা ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বকে জাতীয়তাবাদের একমাত্র প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, আর অন্যদিকে বর্তমান সময়ে নতুন রাজনৈতিক শক্তি NCP (National Citizen Party) — যারা ২০২৪-এর তরুণ নির্যাতিত জনতার গণআন্দোলনের গর্ব এককভাবে দাবি করতে শুরু করেছে।

কিন্তু ইতিহাস এবং বাস্তবতা বলে— কোনো মহান আন্দোলন কখনো একক নেতৃত্বে সফল হয় না, এবং একক কৃতিত্ব দাবি করা মানেই গণআন্দোলনের আত্মাকে হত্যা করা।

আওয়ামী লীগ যদি ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্বকে নিজের একক অর্জন দাবি করে, তাহলে তারা প্রকৃতপক্ষে সেই সংগ্রামের বহুধা রক্তঝরা চরিত্রকে অসম্মান করছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি ছাত্রলীগ, বাম সংগঠন, সাধারণ কৃষক-শ্রমিক, এমনকি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকাও ইতিহাসে রয়ে গেছে।

এটা কোনো একক ব্যক্তির বা দলের অর্জন ছিল না। এটি ছিল একটি জনতার আন্দোলন, একটি জাতির মুক্তির প্রত্যয়। অথচ বর্তমানে আওয়ামী লীগের ভঙ্গিতে মনে হয়, বঙ্গবন্ধু একাই যুদ্ধ করেছিলেন, বাকিরা কেবল দর্শক ছিলেন।

এটি ঐতিহাসিক বিকৃতি। এবং এই বিকৃতি যতদিন চলবে, ততদিন মুক্তিযুদ্ধ হবে একটি দলীয় অস্ত্র—জাতীয় চেতনার নয়।

২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজপথ কাঁপানো গণআন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি ছিল তরুণ প্রজন্ম। চাকরি প্রার্থীরা, শিক্ষার্থীরা, রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার সাধারণ মানুষ—সবাই একত্র হয়েছিল একটি স্বপ্ন নিয়ে: "পরিবর্তনের বাংলাদেশ।"

এই আন্দোলনে NCP-র সাহসী উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে NCP এখন যেভাবে আন্দোলনের কৃতিত্ব এককভাবে দাবি করছে, তা আওয়ামী লীগের ৭১ কৌশলেরই প্রতিচ্ছবি।

তরুণদের রক্ত, মধ্যবিত্তদের কান্না, মায়ের চোখের জল, বুদ্ধিজীবীদের সাহসী কণ্ঠ—এসব যদি কোনো একক দল নিজের বলে দাবি করে, তবে সেই আন্দোলন ইতিহাসে মরে যায়, মরে যায় গণমানুষের ভূমিকা।

এটাই ঘটেছে আওয়ামী লীগের সাথে, এখন সেই একই পথে হাঁটছে NCP।

বাংলাদেশে রাজনীতির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো: সম্মিলিত কৃতিত্বকে দলীয় কৃতিত্বে রূপান্তর করা।

যে আন্দোলন জনগণের, সেটা যখন একক সংগঠনের দাবি হয়ে যায়, তখন সে আন্দোলন দলীয় হয়ে পড়ে, দলীয় হলে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই ধারা যেসব দল অনুসরণ করেছে—তারাই হারিয়েছে জনসমর্থন, হারিয়েছে নৈতিক অবস্থান।

সমস্যা শুধু একক কৃতিত্ব দাবিতে নয়, সমস্যা সেটিকে ব্যবহার করে অন্যদের ভূমিকা অস্বীকার করার প্রবণতায়। আওয়ামী লীগ ৭১ নিয়ে অন্য দলগুলোকে ‘অমুক্তিযোদ্ধা’ বা ‘রাজাকার’ বানিয়ে ফেলেছে, আর NCP বর্তমানে অন্য দল বা সংগঠনকে আন্দোলনের ‘গণশত্রু’ হিসেবে চিত্রিত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

এই মানসিকতা থেকে বের না হলে, NCP-ও আওয়ামী লীগের মতই শেষ হয়ে যাবে—তাদেরও জনগণ ইতিহাসে শুধুই একনায়কীয় কৌতুক হিসেবে মনে রাখবে।

বাংলাদেশের রাজনীতিকে বাঁচাতে হলে ইতিহাসের মালিকানা নয়, ইতিহাসের অংশীদারিত্বের চর্চা শুরু করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ যেমন সবার ছিল, গণআন্দোলনও তেমনি সবার।

নতুন রাজনৈতিক দলগুলোকে এই শিক্ষা নিতে হবে। জনগণের আন্দোলন জনগণেরই থাকে। কোনো দল তার একচ্ছত্র দাবিদার হতে পারে না।

না হলে ৭১ যেমন আওয়ামী লীগকে শেষ করেছে, ২৪-এর আন্দোলনের কৃতিত্বের একক দাবিও NCP-র পতনের বীজ হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এখানে ইতিহাস কেবল স্মৃতিচারণ নয়, বরং প্রতিদিন রচিত হচ্ছে নতুন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। এই লড়াই জনগণের, কৃতিত্বও তাদের।

যদি আমরা এই সত্য ভুলে যাই, তাহলে বারবার একই ইতিহাসের ভুল আমরা আবার করব—নতুন নামে, নতুন দলের মুখে, কিন্তু একই আত্মঘাতী প্রবণতায়।

তাই বলি—

"৭১ কৃতিত্ব এককভাবে দাবি করে আওয়ামী লীগ শেষ। ২৪-এর আন্দোলনের কৃতিত্ব এককভাবে দাবি করে NCP ও শেষ। কারণ ইতিহাস কখনো একার নয়। ইতিহাস সর্বদাই জনতার।

✍️ আবদুল্লাহ আল মামুন

کوئی تبصرہ نہیں ملا