আদর্শের মুখোশ নয়, আদর্শের সত্য অন্বেষণ চাই

আব্দুল্লাহ আল মামুন avatar   
আব্দুল্লাহ আল মামুন
বর্তমান বাংলাদেশে রাজনীতি যেন এক নাট্যশালার নাম, যেখানে আদর্শ বলতে বোঝানো হয় কেবল একটি মুখোশ—প্রয়োজনে যেটা পরা যায়, আবার প্রয়োজন ফুরালে ফেলে দেওয়া যায়।..

 অথচ আদর্শ শব্দটা কোনো সময়িক পরিচয়ের নয়, এটি চেতনাগত, নৈতিক, আত্মিক এবং চিরস্থায়ী পথনির্দেশ। কিন্তু আজকের রাজনীতিবিদেরা, বিশেষত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, ‘আদর্শ’ শব্দটির অপব্যবহার করে চলেছেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর।

একজন নেতা বলেন—“আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করি”, আরেকজন বলেন—“আমি জিয়াউর রহমানের আদর্শে রাজনীতি করি।” কেউ বলেন—“আমরা এরশাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছি।” কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই নেতারা কি আদর্শের মর্মবস্তু অনুধাবন করেছেন? আদর্শ কি শুধুই একটা দলীয় স্লোগান? নাকি এটা জীবনের সব ক্ষেত্রে—নৈতিকতা, মানবিকতা ও সত্য প্রতিষ্ঠার পথ?

আমরা দেখি, যারা মুখে জিয়ার আদর্শের কথা বলেন, তারা নিজেরাই কখনও কোরআনের আদর্শ মানেন না, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ান না। যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসের কথা বলেন, তারাও খোদ বঙ্গবন্ধুর সততা, ত্যাগ বা মানবিকতা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছেন। তারা কেবল তাঁর নামটি ব্যবহার করেন নিজের ক্ষমতা রক্ষার ঢাল হিসেবে।

অথচ আমরা মুসলমান। আমরা বিশ্বাস করি, আদর্শ হবার প্রকৃত যোগ্যতা একমাত্র আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মধ্যেই রয়েছে। তিনি কখনো মিথ্যা বলেননি, অন্যায় করেননি, কারও সম্পদ লুট করেননি, কাউকে দমন-পীড়ন করেননি। তিনি ছিলেন মানবতার শ্রেষ্ঠ আদর্শ। তারপরও আজ আমরা কেন ‘নবীর আদর্শ’ নয়, ‘নেতার আদর্শ’ সামনে তুলে ধরি? কেন একজন মুসলমান হয়ে আমি জিয়াউর রহমান বা শেখ মুজিবকে আমার চূড়ান্ত আদর্শ মনে করব, যাঁদের মধ্যে ভালো-মন্দ দুই দিকই ছিল? কেন আমি নবীর মতো আদর্শকে সামনে রাখব না, যাঁর মধ্যে কোনো মন্দই ছিল না?

আসলে, আজকের রাজনীতির নামে আমরা যা দেখি তা আদর্শ নয়, সেটা সুবিধাবাদী স্বার্থান্বেষী দলীয় মুখোশ। তারা মুখে যা বলেন, কাজে করেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত। একবার আপনি একজন বিএনপি নেতাকে ক্যামেরার সামনে এনে বলুন—“বঙ্গবন্ধুর ভালো দিকগুলো তুলে ধরুন।” তিনি পারবেন না। কারণ দল তার আদর্শ নয়, পদ-পদবি আর ক্ষমতা তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান।

ঠিক তেমনিভাবে, একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে বলুন—“জিয়াউর রহমানের কোনো ইতিবাচক দিক বলুন।” বলবে না। কেননা বললেই তার ‘আদর্শিক পরিচয়’ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। তার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। এই হলো আজকের তথাকথিত ‘আদর্শ’। যে আদর্শ সত্যকে সত্য বলতে দেয় না, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেয় না, সে আদর্শ নয়—সেটা ভণ্ডামি।

আমরা দেখছি, আজ রাজনীতির নামেই চলছে অবৈধ ইনকামের খেলা, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট, লুটপাট, দখল, গ্যাঞ্জাম আর প্রাসাদ নির্মাণের প্রতিযোগিতা। অথচ নবী বলেছিলেন—“সততা হলো ঈমানের অংশ।” কিন্তু তারা সে কথা মানেন না। কেউই চান না নবীর আদর্শে ফিরে যেতে। কারণ তাতে তো ঘুষ খাওয়া যাবে না, অন্যায় দমন করতে হবে, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।

এইসব মুখোশধারী নেতাদের সময় শেষ হয়ে এসেছে। জনগণ এখন সব বুঝে গেছে। তারা আর শুধু নামধারী রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। আজ সময় এসেছে, মানুষ একজোট হয়ে দাঁড়াবে, সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলার সাহস দেখাবে। এই মুখোশধারী, আদর্শবিহীন ক্ষমতালোভী নেতাদের মানুষ চিহ্নিত করবে এবং তারা বাধ্য হবে দেশ ছেড়ে পালাতে—যেমন একসময় শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছিলেন।

এই আলোচনার শেষ কথা—আমাদের প্রয়োজন কোনো দলীয় আদর্শ নয়, প্রয়োজন মানবিকতা, ধর্মীয় নৈতিকতা ও সত্যের অনুসরণ। আদর্শ হতে হবে এমন, যা সত্য বলার সাহস দেয়, ন্যায়ের পাশে দাঁড়ায় এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কেবল তখনই বাংলাদেশ হবে একটি আদর্শ রাষ্ট্র।

লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

No comments found


News Card Generator