৯ বিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন ও কঠিন চ্যালেঞ্জ

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
নিউ ইয়র্ক সিটির রাজনীতিতে একসময় ‘আন্ডারডগ’ হিসেবে পরিচিত মামদানির এই জয় কেবল ব্যক্তির নয়, এটি বহু দশক ধরে শহরবাসীর মধ্যে জমা হওয়া সাশ্রয়ী মূল্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।..

ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র-ইলেক্ট হিসেবে জোহরান মামদানির অপ্রত্যাশিত বিজয় শহরের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। এখন তাঁর সামনে রয়েছে সাশ্রয়ী মূল্যের উচ্চাকাঙ্ক্ষী এজেন্ডা বাস্তবায়নের বিশাল চ্যালেঞ্জ শীর্ষ ধনীদের ওপর কর বৃদ্ধি করে ৯ বিলিয়ন ডলার তহবিল গঠনের তাঁর পরিকল্পনা এরই মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

নিউ ইয়র্ক সিটির রাজনীতিতে একসময় ‘আন্ডারডগ’ হিসেবে পরিচিত মামদানির এই জয় কেবল ব্যক্তির নয়, এটি বহু দশক ধরে শহরবাসীর মধ্যে জমা হওয়া সাশ্রয়ী মূল্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।

পুয়ের্তো রিকোর বার্ষিক সোমোস কনফারেন্সে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে মামদানি এই জয়ের মূল কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি জানান, ভোটাররা এমন একটি প্রশাসনের জন্য ম্যান্ডেট দিয়েছে, যা ১৯৫০-এর দশকের পর দেখা যায়নি এমন একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী সাশ্রয়ী মূল্যের এজেন্ডা কার্যকর করবে।

নির্বাচনে দুই মিলিয়নেরও বেশি ভোটার ভোট দিয়েছেন, যা একটি ঐতিহাসিক টার্নআউট। এই রেকর্ড ভোটদানের হার প্রমাণ করে, নিউ ইয়র্কবাসী শুধু রাজনীতিতে আগ্রহী নন, বরং তারা বাস্তব পরিবর্তনের ফল দেখতে চান। মামদানি বলেন, “আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে গত এক বছর ধরে আমরা যে কাজটি করেছি, তা আমাদের এই এজেন্ডা কার্যকর করার ম্যান্ডেট দিয়েছে।”

মামদানির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কেন্দ্রে ছিল তিনটি প্রধান প্রতিশ্রুতি: সার্বজনীন শিশু যত্ন, শহরের বাস পরিষেবা বিনামূল্যে ও দ্রুত করা, এবং আবাসন খরচ কমানো। এই বিশাল এজেন্ডার জন্য অর্থের সংস্থান করাই এখন তাঁর প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৯ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহের স্পষ্ট রূপরেখা দিয়েছেন মামদানি। এই তহবিলের সংস্থান হবে দুটি প্রধান কর বাড়ানোর মাধ্যমে:

১. শীর্ষ আয়ের উপর ব্যক্তিগত কর বৃদ্ধি: যেসব নিউ ইয়র্কবাসী বছরে ১ মিলিয়ন ডলার বা তার বেশি আয় করেন, তাদের উপর ব্যক্তিগত আয়কর ২% বৃদ্ধি করা। ২. কর্পোরেট কর বৃদ্ধি: রাজ্যের শীর্ষ কর্পোরেট করের হার নিউ জার্সির সমতুল্য করা।

তবে এই দুই কর প্রস্তাবই মামদানির প্রশাসনের জন্য রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। রাজ্য আইনসভার অনুমোদন এবং শক্তিশালী কর্পোরেট লবিং-এর চাপ মোকাবিলা করাই হবে তাঁর প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই অর্থ কেবল তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে না, বরং ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আসা ‘বিধ্বংসী কাটছাঁট’ থেকে নিউ ইয়র্কবাসীদের রক্ষাও করবে।

মামদানির এই জয়ের আড়ালে লুকিয়ে আছে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংঘাত। ট্রাম্প প্রশাসন তাঁর প্রশাসনকে অর্থায়ন বন্ধের হুমকি দিয়েছিলেন।

এই পরিস্থিতিতে হোয়াইট হাউসের সাথে সংঘাত মোকাবিলায় মামদানি একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান তুলে ধরেছেন। তিনি জানান, যদি ট্রাম্প জীবনযাত্রার খরচ কমানোর মতো সাধারণ বিষয়ে কাজ করতে চান, তবে তিনি প্রস্তুত।

তবে তিনি একই সাথে কঠোর হুঁশিয়ারিও দেন। মেয়র-ইলেক্ট সতর্ক করেন, যদি প্রেসিডেন্ট এমন একটি পরিকল্পনা নিয়ে আসেন যা ‘আমেরিকান ইতিহাসে বৃহত্তম নির্বাসন বাহিনী’ তৈরির প্রতিশ্রুতি কার্যকর করার চেষ্টা করে, তবে তিনি প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াই করবেন। এর মধ্য দিয়ে মামদানি স্পষ্ট করে দেন যে, অর্থনীতিতে সহযোগিতার সুযোগ থাকলেও অভিবাসন নীতি এবং সামাজিক সুরক্ষার মতো মৌলিক বিষয়ে কোনো আপস করা হবে না।

জোহরান মামদানির প্রতি জনসমর্থন যেমন ব্যাপক, তেমনই তাঁর নীতিকে কেন্দ্র করে একটি মেরুকরণও বিদ্যমান। ব্যবসায়িক সম্প্রদায় এবং ইহুদি ভোটারদের মধ্যে তাঁর নীতির বিরুদ্ধে থাকা উদ্বেগ তিনি স্বীকার করেছেন।

তিনি নিশ্চিত করেন যে তাঁর প্রশাসন কেবল তাঁর ভোটারদের নয়, বরং ৮.৫ মিলিয়ন নিউ ইয়র্কবাসীকে প্রতিনিধিত্ব করবে। তিনি বলেন, তিনি এমন সিটি হল গড়তে চান, যা ইহুদি নিউ ইয়র্কবাসীদের সাথে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবে এবং শহরে ইহুদি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করবে।

ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের জন্য চাপ কমাতে তিনি ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির উপর জরিমানা ও ফি ৫০% কমানোর পরিকল্পনা করেছেন। এর মাধ্যমে লাইসেন্স এবং আইনি জটিলতা হ্রাস করে নিউ ইয়র্কে ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ তৈরির লক্ষ্য তাঁর।

ক্ষমতা গ্রহণের আগে মামদানি তাঁর প্রাথমিক ট্রানজিশন টিম সম্পূর্ণভাবে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নারীদের নিয়ে গঠিত করেছেন। এটি তাঁর প্রশাসনের মেধাভিত্তিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপরেখার ইঙ্গিত দেয়।

এছাড়াও, তিনি গৃহহীনতা নামক মানবিক সংকট মোকাবিলায় বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন। নিউ ইয়র্ক সিটির পাবলিক স্কুল সিস্টেমে ১ লাখ ৫৪ হাজার শিক্ষার্থী গৃহহীন ছিল, যা তাঁর মতে ‘লজ্জাজনক’। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁর প্রশাসন ‘Every Child and Family is Known’ নামে একটি পাইলট প্রোগ্রামকে শত শত স্কুলে সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা করেছে। এই পদ্ধতি গৃহহীন শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করবে।

মেয়র-ইলেক্ট হিসেবে জোহরান মামদানির দায়িত্ব গ্রহণ নিউ ইয়র্ক সিটির রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষী ৯ বিলিয়ন ডলারের কর প্রস্তাব রাজ্যের রাজনীতিতে ঝড় তুলবে, আর একই সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে সংঘাত এড়িয়ে 'ট্রাম্প-প্রুফ' শহর গড়ার অঙ্গীকারও তাঁকে বজায় রাখতে হবে।

শহরের বিভক্ত রাজনীতিকে ঐক্যের পথে ফিরিয়ে আনা তাঁর প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হতে পারে। মেয়র-ইলেক্ট হিসেবে জোহরান মামদানির প্রথম ১০০ দিনই নির্ধারণ করবে, তাঁর ৯ বিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন কতটা বাস্তব, আর নিউ ইয়র্ক সত্যিই কি আরও ন্যায্য শহরে পরিণত হতে পারে।

No comments found


News Card Generator