ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (WEF) ভয়াবহ ভবিষ্যদ্বাণী—আগামী দুই বছরেই বিশ্বজুড়ে প্রায় ৮ কোটি চাকরি বিলীন হতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-এর কারণে। এই সংখ্যাটি ৮ কোটি পরিবারকে চরম হতাশা, সামাজিক অস্থিরতা ও মানসিক স্বাস্থ্য সংকটে ফেলতে পারে। কিন্তু এই মহাবিপদের মধ্যেও প্রযুক্তি জায়ান্ট ইলন মাস্ক ও বিল গেটসের মতো ব্যক্তিত্বরা ভবিষ্যতের যে তিনটি ‘নন-টেক’ বা মৌলিক মানবিক দক্ষতার দিকে ইঙ্গিত করছেন, সেটাই এখন চাকরি বাঁচানোর একমাত্র পথ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্বজুড়ে চলছে ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ বা বিশাল প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো মূলত তাদের মুনাফার মার্জিন বাড়াতে এআইকে ব্যবহার করছে।
-
কৌশলগত বিনিয়োগ: অ্যামাজন বা মাইক্রোসফটের মতো টেক-জায়ান্টরা এনভিডিয়া বা ওপেন এআই-এর মতো প্ল্যাটফর্মে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে এই উদ্দেশ্যে যে, তারা যেন এমন সফটওয়্যার তৈরি করে যা প্রতি মাসে কর্মীদের বেতনের পরিমাণ কমিয়ে দেবে এবং বিপুল সংখ্যক মানুষকে প্রতিস্থাপন করবে।
-
টেক-জগতে সংকোচন: এর ফলস্বরূপ, গোটা টেক-জগতেই চাকরি কমছে। যেখানে আগে একটি কাজ ২০ জন মানুষ করতেন, এখন সেই কাজ একজন মানুষ এআই ব্যবহার করে করছেন, যা কার্যত ২০ জনকে প্রতিস্থাপন করছে। এই প্রক্রিয়াকে কোম্পানিগুলো ‘নিম্বল’ বা ‘এজাইল’ বললেও, এর সরল অর্থ হলো ধনী আরও ধনী হচ্ছে এবং প্রফিট মার্জিন বাড়ছে।
তবে, এই সংকটের মধ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘প্যারাডক্স’ বা বিপরীত বাস্তবতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
প্রচলিত ধারণা হলো পৃথিবী শুধু সামনের দিকে এগোচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, কিছু ক্ষেত্রে পুরনো ও মৌলিক জিনিসের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে।
-
বিল গেটসের কৌশল: প্রযুক্তি বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি বিল গেটস এখন আমেরিকার শীর্ষ তিন ফার্মল্যান্ড (কৃষিভূমি) মালিকের একজন। সারাজীবন টেক নিয়ে কাজ করা এই ব্যক্তির ডিভোর্সের পর টেকে আরও বেশি বিনিয়োগ করার কথা থাকলেও, তিনি বিনিয়োগ করছেন নন-টেকে। এই বিষয়টি স্পষ্ট করে যে, টেক-বিপজ্জনক হলেও মৌলিক সম্পদ (যেমন জমি, স্বর্ণ) হাজার বছর ধরে মানবসভ্যতা ও অর্থনীতিকে ধরে রেখেছে।
-
এলন মাস্ক ও এনভিডিয়া প্রধানের ভবিষ্যদ্বাণী: এনভিডিয়ার সিইও মনে করেন, ভবিষ্যতে প্লাম্বার এবং ইলেকট্রিশিয়ানরা কোটিপতি বা মিলিয়নিয়ার হবেন। কেন? কারণ এলন মাস্কের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এআই যে গতিতে বাড়ছে, সেই গতিতে রোবট এগোতে পারবে না। মানুষের হাত এত জটিল যে, রোবট এখনও কার্যকরীভাবে মানুষের হাতের কাজ প্রতিস্থাপন করতে পারেনি। তাই মানুষের হাতের কাজের প্রয়োজন আরও অনেক বছর ধরে থাকবে।
এআই-এর যুগে চাকরি বাঁচাতে হলে যে তিন ধরনের মৌলিক দক্ষতা বা শিল্পে মনোযোগ দিতে হবে, তা নিম্নরূপ:
১. কৃষি ও মৎস্য শিল্প (Agriculture & Fishing)
কৃষি ও মৎস্য শিল্পকে সবচেয়ে সুরক্ষিত এবং সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
-
বিশাল সুযোগ: জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এর মতে, পৃথিবীর প্রায় ৬০ শতাংশ চাষযোগ্য জমি এখনও অনাবাদী পড়ে আছে। আফ্রিকার ৯০ শতাংশ জমি এখনও চাষ করা হয়নি। এই বিশাল অনাবাদী জমিতে কাজ করলে কোটি কোটি মানুষের জীবিকা নির্বাহ সম্ভব।
-
এআই কেন ব্যর্থ: এআই চাইলেও মাটিকে উর্বর করতে পারবে না বা ইলিশ মাছ বানাতে পারবে না। এআই কৃষকদের সহায়তা করতে পারে, কিন্তু কৃষিকাজ বা মাছ ধরার মূল প্রক্রিয়াটি বদলাতে পারবে না।
-
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর মাটির দেশগুলোর একটি। অথচ এদেশের মেধাবী তরুণরা ফার্মিং শিখতে আগ্রহী নয় এবং ফার্মিংকে সমাজে যথেষ্ট সম্মানও দেওয়া হয় না। বিশ্লেষকের মতে, তরুণদের ফার্মিং ও ফিশিংয়ে বিনিয়োগ করলে দেশের অর্থনীতি ১০ থেকে ২০ গুণ বড় হতে পারে।
২. মানবিক স্পর্শ ও কারিগরি দক্ষতা (Human Touch & Technical Skills)
যেসব কাজে সরাসরি মানুষের স্পর্শ প্রয়োজন, এআই তা দ্রুত প্রতিস্থাপন করতে পারবে না।
-
চাহিদা বৃদ্ধি: স্কুল টিচার, কেয়ারগিভার, নার্স, শেফ, প্লাম্বার, ইলেকট্রিশিয়ান, বা যারা চুল কাটেন—এই সব জায়গাতেই মানুষের প্রয়োজন আরও বাড়বে। জাপান, ইউরোপ ও আমেরিকাতে কেয়ারগিভার এবং নার্সের বিশাল চাহিদা রয়েছে।
-
চীন মডেল: চীনের অর্থনৈতিক উত্থানের কারণ হলো তাদের মধ্যবিত্তের একটি বিশাল অংশ কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত। তারা হাতের কাজে এত দক্ষ যে, তারা বৈশ্বিক অর্থনীতির চালক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের তরুণদের শুধু বাংলা বা ফিলোসফি না পড়িয়ে এসি ঠিক করা, গাড়ি মেরামত করা বা নার্সিংয়ের মতো হাতে-কলমে কাজ শেখানো উচিত।
৩. সৃজনশীলতা ও মানবিক যোগাযোগ (Creativity & Human Communication)
যে কোনো মৌলিক আইডিয়া বা ক্রিয়েশন তৈরি করার ক্ষমতা এআই-এর পক্ষে রেপ্লিকেট করা কঠিন।
-
এআই’র সীমাবদ্ধতা: একটি সিনেমা, একটি মৌলিক গল্প বলার ক্ষমতা, নেগোসিয়েশন স্কিল (Negotiation Skill), সেলস স্কিল (Sales Skill) বা অপরিচিত মানুষের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলার ক্ষমতা—এসব মানবিক দক্ষতা এআই মানুষের কাছ থেকে সবার শেষে নিয়ে যাবে (যদি আদৌ নেয়)।
-
যোগাযোগের ঘাটতি: বর্তমানে ২০ বছরের নিচে থাকা তরুণদের একটি বড় অংশের মধ্যে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারার বা কার্যকরভাবে নেগোসিয়েট করার দক্ষতার অভাব দেখা যায়। এই ধরনের মানবিক যোগাযোগ দক্ষতাই ভবিষ্যতে কর্মজীবনে সবচেয়ে বড় সুবিধা দেবে।
এআই নিয়ে ‘দাজ্জাল’ বা ডুমস-ডে’র মতো চরম আতঙ্ক থাকলেও, এটিকে কেবল ধ্বংসকারী হিসেবে না দেখে সহায়ক (Assistant) হিসেবে দেখা উচিত। এআই নিঃসন্দেহে সমাজের ব্যাপক ক্ষতি করবে এবং ধনী কোম্পানিগুলোকে আরও শক্তিশালী করবে, কিন্তু একইসঙ্গে কৌশলী হওয়ার সুযোগও তৈরি করেছে।
চাকরি বাঁচাতে হলে শুধু সিএসই বা টেক-জবে মনোনিবেশ না করে, ভবিষ্যতের জন্য স্ট্র্যাটেজিক পজিশনিং জরুরি। এর অর্থ হলো, একদিকে এআই-কে ব্যবহার করে নিজের দক্ষতা বাড়ানো, অন্যদিকে জমির মতো নন-টেক সম্পদে বিনিয়োগ করা এবং মাটির কাজ, কারিগরি দক্ষতা ও সৃজনশীলতার মতো মৌলিক মানবিক সক্ষমতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এই মিশ্র কৌশলই ভবিষ্যতে একজন মানুষকে এআই-এর চ্যালেঞ্জ থেকে শুধু রক্ষা করবে না, বরং তাকে আরও ধনী ও সফল হতে সাহায্য করবে।



















