দিয়াবাড়ীতে বিমান দুর্ঘটনার পর সেনাবাহিনীর যে মানবিক উদ্ধার অভিযান দেশবাসীর হৃদয় ছুঁয়ে গেছে—সেখানে এক মা ও ছেলের মরদেহ ঢাকতে সেনা সদস্যরা খুলে ফেলেছেন নিজের গর্বের ইউনিফর্ম। এই ঘটনা হয়ে উঠেছে মানবতার অনন্য নজির।
বিমান দুর্ঘটনার মতো ভয়াবহ মুহূর্তে যখন চারপাশ জ্বলছিল আগুনে আর বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল ধোঁয়ার কুণ্ডলী, তখন এক দল মানুষ ছুটে এসেছিল জীবনের জন্য। দিয়াবাড়ী মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কাছেই অবস্থিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থেকে যোদ্ধারা ছুটে আসেন, যখন বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে স্কুল চত্বরে পড়ে আগুন ধরে যায়।
বিধ্বস্ত জায়গায় পৌঁছেই তাঁরা দেখেন, জ্বলন্ত ধ্বংসাবশেষের পাশে পড়ে আছে দুইটি মরদেহ—একজন মা ও তাঁর শিশু সন্তান। সে দৃশ্য যে কতটা হৃদয়বিদারক ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। ঠিক তখনই সেনাবাহিনীর দুই সদস্য, মেজর মেহেদী হাসান ও সৈনিক আশিক, নিজেদের গর্বের ইউনিফর্ম খুলে মরদেহ দুটি ঢেকে দেন। এই মানবিকতার নিদর্শন শুধু তাদের দায়িত্ব নয়, ছিল এক গভীর আত্মিক সম্মান ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ।
এই অসাধারণ দৃশ্য ধরা পড়ে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের ক্যামেরায়, যা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। দেশজুড়ে মানুষ আবেগে আপ্লুত হয়ে জানতে চান, কারা এই দুইজন সাহসী সৈনিক? কে তাঁরা, যাঁরা নিজেদের সবচেয়ে প্রিয় ও মর্যাদাপূর্ণ পোশাক দিয়ে মরদেহ ঢেকে দিয়েছেন?
এই ঘটনাটি নিয়ে মন্তব্য করেন অনেকেই। কেউ বলেন, “এটা শুধু ইউনিফর্ম না, এটা সৈনিকদের চামড়া। ওরা তা খুলে দিয়ে মানবতার জন্য নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে।” আরেকজন বলেন, “এই জন্যই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের গর্ব।”
মেজর মেহেদী হাসান জানান, “দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই আমরা সেখানে পৌঁছে যাই। ১০০-১৫০ গজ দূরত্ব ছিল মাত্র। স্পটে প্রবেশ করে দেখি একটি নারী ও একটি শিশুর মরদেহ পড়ে আছে। আমরা তখন আমাদের ইউনিফর্ম খুলে মরদেহ দুটি ঢেকে দিই। আমাদের চোখে, ওই মরদেহের সম্মান আমাদের পোশাকের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি আরও জানান, উদ্ধারকাজে ২৫ জন সেনা সদস্য আহত হন, যাঁদের মধ্যে ১১ জন বর্তমানে সিএমএইচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। “আমরা কাউকে গণনা করিনি, কেবল যাঁদের পেয়েছি তাঁদের জীবন বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছি,” বলেন মেজর মেহেদী।
একজন সেনা কর্মকর্তা বলেন, “যে শিক্ষার্থী আগুনে অসুস্থ হয়ে ক্লাসরুমে আটকা পড়েছিল, তাকে পানি ঢেলে ও জানালার গ্রিল ভেঙে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এই সাহস ও ত্যাগের দৃশ্য সেনাবাহিনীর মানবিক দায়িত্ববোধের প্রকৃত প্রতিফলন।”
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাহেদুর রহমান বলেন, “এই ঘটনা নিছক উদ্ধার নয়, এটা মানবিকতার শ্রেষ্ঠ রূপ।” তিনি বলেন, “মেজর মেহেদী এবং সৈনিক আশিকের মতো সদস্যদের জন্যই আজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতির আস্থা।”
মেজর জেনারেল (অব.) কাজী ইফতেখার-উল-আলম বলেন, “শিশুদের জীবন হঠাৎ থেমে গেছে, যাদের সামনে নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ ছিল। এই ক্ষতি পূরণযোগ্য নয়। কিন্তু সেনাবাহিনী যেভাবে কাজ করেছে, তাতে বোঝা যায়, এখনো এই জাতির হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়ার মতো মানুষ আছে।”
এই দুর্ঘটনা এবং তার পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতা আবারও প্রমাণ করে দিয়েছে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী শুধু লড়াইয়ের সময়ই নয়, বরং যে কোনো দুর্যোগে মানুষের পাশে থেকেছে, থাকছে, এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।