মধ্যপ্রাচ্যে টানটান উত্তেজনা ও অব্যাহত সংঘাতের মধ্যেই বড়সড় চমক দিয়ে নতুন কৌশলগত প্রস্তাব দিয়েছে ইরান। দেশটির শীর্ষ নেতা ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক-সামরিক ব্যক্তিত্ব মহসেন রেজাই সম্প্রতি এক ঘোষণায় জানিয়েছেন, ইরান সৌদি আরব, তুরস্ক এবং পাকিস্তানের সঙ্গে একযোগে একটি ‘ইসলামিক সেনাবাহিনী’ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই বহুজাতিক বাহিনী গঠনের লক্ষ্য হলো মুসলিম দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
রেজাইয়ের মতে, মুসলিম বিশ্বের চলমান সংকট ও নিরাপত্তাহীনতার পেছনে বহিঃশক্তির সরাসরি হস্তক্ষেপ রয়েছে। তিনি বলেন, “আমাদের উচিত একত্রিত হয়ে নিজেদের আত্মরক্ষা নিশ্চিত করা। একমাত্র সম্মিলিত শক্তির মাধ্যমেই আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবো।”
এই প্রস্তাব আসার সময়টা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, মাত্র একদিন আগেই ইরান ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিব এবং বন্দরনগরী হাইফায় ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এই হামলায় অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন এবং অনেক আহত। বেসামরিক ঘরবাড়ি, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং মার্কিন দূতাবাসের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র তাদের দূতাবাস বন্ধ ঘোষণা করে এবং সাত লাখ মার্কিন নাগরিককে ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, “আমাদের ঘাঁটি বা স্বার্থে যদি আবারও হামলা হয়, আমরা সর্বশক্তি দিয়ে জবাব দেবো।”
এই প্রেক্ষাপটে ইরানের ইসলামিক জোট বাহিনী গঠনের প্রস্তাবকে অনেকেই একটি প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখলেও, অনেক বিশেষজ্ঞ এটিকে আঞ্চলিক আধিপত্যের নতুন খেলা হিসেবেও ব্যাখ্যা করছেন।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, যদি এই চারটি দেশ—ইরান, সৌদি আরব, পাকিস্তান ও তুরস্ক—আসলে একটি ইসলামিক বাহিনী গঠন করে, তাহলে শুধু ইসরায়েল নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্য আমূল পরিবর্তিত হতে পারে। তুরস্ক ও পাকিস্তানের রয়েছে শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতা, সৌদি আরবের রয়েছে বিপুল অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব এবং ইরানের রয়েছে আঞ্চলিক পরিসরে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
তবে এই সেনা জোটের বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে মতপার্থক্য এবং প্রতিযোগিতা রয়েছে। একইভাবে তুরস্ক ও ইরান একাধিক ইস্যুতে একমত নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি-ইরান সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে, যা এই প্রস্তাবকে বাস্তবতার পথে এগিয়ে নিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, এই বাহিনী গঠিত হলে তা যেমন আত্মরক্ষার শক্তি হতে পারে, তেমনি তা হতে পারে নতুন ধরনের আঞ্চলিক সংঘাতের সূচনা। কারণ, ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোট এর বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, যা সরাসরি নতুন যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
অন্যদিকে, ইসলামি বিশ্বে এই ঘোষণাকে স্বাগত জানানো হয়েছে অনেক মহল থেকে। মুসলিম বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এটিকে একটি সম্মিলিত শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে, যারা চায় একটি স্বাধীন, সুরক্ষিত এবং আত্মনির্ভর মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের বন্ধন।
ইরানের ইসলামিক সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তাব নিঃসন্দেহে মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত চিত্রপট বদলে দিতে পারে। এটি শুধু রাজনৈতিক বার্তা নয়, বরং এক নতুন সম্ভাবনার পথ—যা একদিকে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের ডাক, আবার অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির নতুন পর্বের সূচনা।



















