তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরবে কিনা, ২০ নভেম্বর জানা যাবে

আই নিউজ বিডি ডেস্ক avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
২৭ আগস্ট, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের সেই পুরোনো রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে করা আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয় এবং আপিলের অনুমতি দেওয়া হয়।..

দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মামলা হিসেবে বিবেচিত, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরানোর আপিলের ওপর টানা ১০ দিনের ম্যারাথন শুনানি শেষ হয়েছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আগামী ২০ নভেম্বর এই ঐতিহাসিক মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছেন।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে করা আপিলের ওপর রায় ঘোষণার জন্য আগামী ২০ নভেম্বর তারিখ নির্ধারণ করেছেন। মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এই তারিখ ধার্য করেন।

টানা ১০ দিন ধরে চলা এই ম্যারাথন শুনানি গত সোমবার শেষ হয়। দেশের সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই মামলার রায়ের দিকে তাকিয়ে আছে পুরো জাতি। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এই পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের অন্য ছয় সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান এবং বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।

আদালতে এই মামলার শুনানিতে বিভিন্ন পক্ষ অংশ নেয়, যা এর গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষে লড়েন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন এবং ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহামদ শিশির মনির।

এছাড়াও, এই মামলায় ইন্টারভেনর বা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, অ্যাডভোকেট মহসীন রশিদ এবং ব্যারিস্টার শাহরিয়ার কবির নিজ নিজ পক্ষের যুক্তি তুলে ধরেন। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক জোরালোভাবে তাদের অবস্থান রক্ষা করেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার এই আইনি লড়াইয়ের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। ১৯৯৬ সালে, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই ব্যবস্থাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় নির্বাচনকে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা।

কিন্তু, ১৯৯৮ সালে এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। সেই রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ রিটটি খারিজ করে দেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করেন।

হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে আপিল করে রিট আবেদনকারীপক্ষ। দীর্ঘ সময় পর, ২০১১ সালের ১০ মে, আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বাতিল ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে যুগান্তকারী এক রায় দেন।

আপিল বিভাগের সেই রায়ের পর, ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়, যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাংবিধানিক কাঠামো থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

তবে, এই বিতর্কের অবসান সেখানেই ঘটেনি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। এই নতুন বাস্তবতায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি আবারও জোরালো হয়ে ওঠে।

গত ২৭ আগস্ট, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের সেই পুরোনো রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে করা আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয় এবং আপিলের অনুমতি দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায়, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তি তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান আপিল করেন।

পরবর্তীকালে, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারও পৃথকভাবে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন। এছাড়া, নওগাঁর রানীনগরের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনও এই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেন।

গত ২১ অক্টোবর থেকে এই সকল আপিলের ওপর একযোগে শুনানি শুরু হয়, যা টানা ১০ দিন চলার পর শেষ হলো।

আগামী ২০ নভেম্বরের এই রায় বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামো এবং আগামী দিনের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে চলমান রাজনৈতিক বিতর্কের প্রেক্ষাপটে, সর্বোচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্তই ঠিক করে দেবে নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কোন পথে এগোবে।

Комментариев нет


News Card Generator