close

ভিডিও আপলোড করুন পয়েন্ট জিতুন!

ঠাকুরগাঁওয়ে এক রাতেই জ্বীন-পরীদের হাতে তৈরি হয়েছিল যে মসজিদ।..

শাহাজাদ ইসলাম avatar   
শাহাজাদ ইসলাম
ঠাকুরগাঁও জেলায় রয়েছে এক ঐতিহাসিক মসজিদ, যা স্থানীয় লোকমুখে 'জ্বিনের মসজিদ' নামেই পরিচিত।..

প্রচলিত আছে, এই মসজিদটি নাকি এক রাতেই জ্বিন-পরীদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। তাদের নিপুণ হাতে তৈরি কারুকার্যময় অলংকরণ ও পুরু দেয়াল প্রমাণ করে এক অভূতপূর্ব নির্মাণশৈলী, যা আজও দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। তবে দিনের আলো ফোটার সাথে সাথেই জ্বিন-পরীরা চলে যায়, আর তাই গম্বুজের কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই দাঁড়িয়ে আছে এই অনন্য স্থাপত্য।

 

ঠাকুরগাঁও জেলাশহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার উত্তরে পঞ্চগড় মহাসড়ক ধরে ভুল্লি বাজার, সেখান থেকে আরও প্রায় তিন কিলোমিটার পূর্বে এই বালিয়া ‘জ্বিনের মসজিদ’ অবস্থিত।

 

সম্প্রতি মসজিদ পরিদর্শনে গিয়ে ফয়সল আলী নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা এই মসজিদের নামকরণের পেছনের গল্প শোনান। তার মতে, কোনো এক অমাবস্যার রাতে জ্বিন-পরীরা বালিয়া ইউনিয়নের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় এই স্থানটি তাদের পছন্দ হয়। এরপর তারা মাটিতে নেমে এসে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করে। কিন্তু ভোরের আলো ফোটার আগেই তাদের কাজ অসমাপ্ত রয়ে যায়, বিশেষ করে গম্বুজ তৈরির আগেই তারা চলে যায়। এই কারণেই মসজিদটি গম্বুজবিহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে এবং স্থানীয়দের কাছে এটি 'জ্বিনের মসজিদ' নামে পরিচিতি লাভ করে।

 

মসজিদের স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণ

 

মসজিদটি সমতল ভূমি থেকে ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উঁচু একটি প্লাটফর্মের ওপর অবস্থিত। পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি আয়তাকার এই কমপ্লেক্সটি সিঁড়িসহ প্রবেশপথ, খোলা চত্বর এবং মূল নামাজঘর—এই তিন অংশে বিভক্ত। মূল ভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট ১১ ইঞ্চি প্রশস্ত এবং প্লাটফর্ম থেকে এর ছাদ ১৭ ফুট উঁচু।

 

মসজিদের ছাদে একই আকারের তিনটি গম্বুজ এবং আটটি মিনার রয়েছে। এর মধ্যে চার কোণের চারটি মিনার বড় এবং বাকি চারটি ছোট। পুরো মসজিদটিই চুন-সুরকির মর্টার এবং হাতে পোড়ানো ইট দিয়ে নির্মিত। ইটে সরাসরি কোনো কাজ না থাকলেও মসজিদের দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে ইট কেটে কলস, ঘণ্টা, ডিশ, বাটি, আমলকি, পদ্ম ইত্যাদি নকশা তৈরি করা হয়েছে, যা এর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

 

মসজিদের ইতিহাস ও সংস্কার:

 

স্থানীয় বাসিন্দা কুদ্দুস আলী জানান, মসজিদটির বয়স প্রায় ১১৫-১১৬ বছর। একসময় এই এলাকাটি একটি উঁচু ও পিরামিড আকৃতির ছিল এবং বন-জঙ্গলের মধ্যেই ছোট্ট একটি মসজিদ ঘরে এলাকার মানুষ নামাজ আদায় করত। পরে মসজিদ কমিটি ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় মসজিদের বাকি কাজ সম্পূর্ণ করা হয়।

 

মসজিদের গায়ে খোদাই করা সন অনুযায়ী, এটি ১৩১৭ বঙ্গাব্দে (১৯১০ খ্রিস্টাব্দ) নির্মিত হয়। এর নির্মাতা জমিদার মেহের বকস চৌধুরীর কবরেও তার মৃত্যুর সন হিসেবে ১৩১৭ বঙ্গাব্দ খোদাই করা আছে, যা নির্দেশ করে তার মৃত্যুর সময়েই মসজিদের বেশিরভাগ কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল।

 

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে জমিদার মেহের বকস চৌধুরী বালিয়াতে একটি মসজিদ তৈরির পরিকল্পনা করেন। এজন্য দিল্লির আগ্রা অথবা মুর্শিদাবাদ থেকে স্থপতি আনা হয়। মুঘল স্থাপত্যরীতি অনুযায়ী ডিজাইনকৃত এই মসজিদ তৈরি ছিল বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। হঠাৎ প্রধান স্থপতির মৃত্যুর কারণে মসজিদের কাজ থেমে যায়। মেহের বকস এরপর স্থানীয় কারিগরদের সহায়তায় কাজ শুরু করেন, কিন্তু তারা মসজিদের গম্বুজ নির্মাণে ব্যর্থ হন। ১৯১০ সালে মেহের বকস চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন এবং তার মৃত্যুর পর মসজিদটি গম্বুজ ছাড়াই অসম্পূর্ণ অবস্থায় থেকে যায়।

 

তবে, মেহের বকস চৌধুরীর ছেলে মরহুম বসরত আলী চৌধুরীর কন্যা এবং বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি তসরিফা খাতুন ২০১০ সালে ইনস্টিটিউটের কারিগরি সহায়তায় বালিয়া মসজিদটির সংস্কার কাজ শুরু করেন। একই সাথে আর্কিটেক্ট সৈয়দ আবু সুফিয়ান কুশলের নকশায় নতুনভাবে গম্বুজ নির্মাণ করা হয়, যা মসজিদটিকে তার পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করে। 

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা প্রশাসন (ইউএনও )খাইরুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন ,বালিয়া মসজিদ কে ঘিরে বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এর চারপাশে বারোমাসি ফুলগাছ দিয়ে সাজানো, মসজিদের সামনের পুকুর সংস্কার করে চারপাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ, সৌন্দর্যবর্ধক দেয়াল নির্মাণসহ আরও কিছু কাজের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। মসজিদ কমিটির সবাইকে সাথে নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় উপজেলা প্রশাসন এই কাজগুলো এগিয়ে নিতে যাচ্ছে।

২৯/৫/২০২৫

মোবাইল:০১৭২১৪৪৭২৩০

No comments found


News Card Generator