close
কমেন্ট করুন পয়েন্ট জিতুন!
ঠাকুরগাঁওয়ে হারিয়ে যাওয়া ১৩ নদ-নদীর সন্ধান: ইতিহাসের পাতা থেকে বাস্তবতায় ফিরবে কি?


ঠাকুরগাঁও জেলার বুক চিরে একসময় প্রবাহিত হওয়া ১৩টি নদ-নদী আজ শুধুই স্মৃতি। একসময়ের প্রাণবন্ত জলধারা, যেখানে লঞ্চ-ট্রলার চলত, জেলেরা মাছ ধরত, আর কোলাহলে মুখর ছিল নদীপারের জনপদ—সেই নদীগুলো আজ প্রায় বিলুপ্ত। তবে সম্প্রতি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) একটি অনুসন্ধান পরিচালনা করে, যেখানে এই ১৩টি হারিয়ে যাওয়া নদীর অস্তিত্বের সন্ধান মেলে।
নদীগুলোর বর্তমান অবস্থা
হারিয়ে যাওয়া ১৩টি নদ-নদী হলো— রশিয়া, হাতুরি, জলই, পুনর্ভবা, মরা গোগরা, চাড়াল বান্দ, নহনা, আমান-ধামান, কাহালাই, বাগমারা, সারডুবি, মরাটাঙ্গন ও ভক্তি নদ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশির ভাগ নদী শুকিয়ে গেছে এবং সেগুলো এখন চাষাবাদের জমিতে পরিণত হয়েছে। কোথাও কোথাও ক্ষীণ স্রোতোধারা এখনো জানান দিচ্ছে যে একসময় এখানে নদী প্রবাহিত ছিল।
"নদীগুলোর অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে"—স্থানীয়দের দাবি
ঠাকুরগাঁও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম যাকারিয়া জানান, বর্তমানে জেলায় চিহ্নিত নদীর সংখ্যা মাত্র ১৪টি। নতুন করে পাওয়া ১৩টি নদীর তথ্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। সরকার অনুমোদন দিলে নদীগুলো দখলমুক্ত করে পুনরায় খননের কাজ শুরু করা হবে।
সদর উপজেলার ভেলাজান এলাকার স্কুলশিক্ষক রফিকুল ইসলাম (৬৫) বলেন, "ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনেছি, এই নদীতে বড় বড় লঞ্চ চলত। এখন শুধু স্মৃতি হয়ে আছে।"
সদর উপজেলার শুখানপুকুরী ও বালিয়া ইউনিয়নে উৎপত্তিস্থল হওয়া ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সারডুবি নদ আজ মৃতপ্রায়। স্থানীয় বাসিন্দা আয়েশা বেগম (৬০) বলেন, "আগে এই নদীর পানি দিয়ে আমরা রান্না করতাম, কাপড় ধুতাম। এখন নদীটিই নেই, সবকিছু কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।"
নদী শুকিয়ে যাওয়ার প্রভাব
পীরগঞ্জ উপজেলার কাহালাই নদ প্রায় পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। এখন সেই জায়গায় ফসল চাষ হচ্ছে।
হাজিপুর ইউনিয়নে অবস্থিত জলই নদ প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। নদীর ধারে থাকা গাছপালাও মরে গেছে, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য দুঃখজনক।
পরিবেশবাদীদের মতে, নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে গ্রীষ্মকালে পানির অভাব দেখা দিচ্ছে এবং কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে।
কৃষক আব্দুল হামিদ (৫০) বলেন, "আগে এই নদীতে নৌকা চলত। মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেত। এখন সেই দিন আর নেই। আমাদের জমিতে সেচ দিতেও সমস্যা হয়।"
কেন হারিয়ে গেল নদীগুলো?
ঠাকুরগাঁওয়ের প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে বলেন, "দীর্ঘদিন ধরে নদীগুলো নাব্যতা হারাতে হারাতে সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। আর এই সুযোগে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকেই বিদায় নিয়েছে অনেক নদী।"
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সৃজন’-এর সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, "কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, ভুল নদী শাসন, দখল ও দূষণের কারণেই এসব নদী হারিয়ে গেছে। আরও অনুসন্ধান করলে হয়তো এই সংখ্যাও বাড়বে।"
নদীগুলো উদ্ধার সম্ভব? কী বলছে প্রশাসন?
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা বলেন, "নদীর সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে ১৩টি নদ-নদীর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ময়দুল ইসলাম রনি বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। এতে বেশির ভাগ নদীতে স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ফলে নদীগুলো উদ্ধার করা কঠিন হবে।"
নদী বাঁচানোর উদ্যোগ না নিলে কী ঘটবে?
পানি সংকট আরও তীব্র হবে।
কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হবে।
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যাবে, যা ভবিষ্যতে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
উপসংহার
নদীগুলো ঠাকুরগাঁওয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অংশ ছিল, পাশাপাশি মানুষের জীবন-জীবিকার অন্যতম উপাদান। তাই সরকার ও স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগে যদি নদীগুলো পুনরুদ্ধার করা যায়, তাহলে শুধু প্রকৃতিই নয়, মানুষের জীবনেও ফিরে আসবে প্রাণের স্পন্দন।
আপনার মতামত দিন: আপনি কি মনে করেন হারিয়ে যাওয়া নদীগুলো পুনরুদ্ধার সম্ভব?
Không có bình luận nào được tìm thấy