সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর টাঙ্গুয়ার হাওরে এবার প্রশাসন নিয়েছে কড়া পদক্ষেপ। হাওরের ওয়াচ টাওয়ার ও আশপাশের এলাকায় পর্যটকবাহী হাউসবোটের চলাচল সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
রবিবার রাতে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক (রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এই পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ওই এলাকায় কোনো হাউসবোট চলাচল করতে পারবে না।
এছাড়া সবাইকে হাওরের পরিবেশ নষ্ট হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকার কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় নেয়া হবে আইনি ব্যবস্থা।
এর আগে শনিবার সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন পর্যটকদের জন্য ১২ দফা নির্দেশনা জারি করে। নির্দেশনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:
-
হাওরে প্রশাসন নির্ধারিত নৌপথ ব্যবহার বাধ্যতামূলক
-
প্রতিটি পর্যটকের লাইফজ্যাকেট পরিধান
-
স্থানীয় গাইডের সহায়তা নেওয়া
-
প্লাস্টিকজাত পণ্য ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ
-
পাখি ও প্রাণী পর্যবেক্ষণে ন্যূনতম দূরত্ব রক্ষা
-
ক্যাম্পফায়ার ও উচ্চ শব্দে গান-বাজনা নিষিদ্ধ
-
মাছ ধরা, শিকার কিংবা পাখির ডিম সংগ্রহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ
-
রাসায়নিক দ্রব্য, ডিজারজেন্ট, শ্যাম্পু ব্যবহার নিষিদ্ধ
-
গাছ কাটা, ডাল ভাঙা, বনজ সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ
-
সংরক্ষিত কোর জোনে প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ
-
হাওরে কোনো প্রকার বর্জ্য ফেলা যাবে না
টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে উদ্বিগ্ন।
শনিবার অনুষ্ঠিত হাওরপাড়ের এক মতবিনিময় সভায় তাঁরা বলেন, হাওরের ভেতরে ইঞ্জিনচালিত নৌযানের অনিয়ন্ত্রিত প্রবেশ প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করছে।
তাঁদের দাবি, হাওরের মাঝখানে পর্যটকদের রাত যাপন বন্ধ করতে হবে এবং সরকারকে দায়িত্বশীল ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।
এর আগে ১৮ জুন ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন হয় টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায়।
সেখানে ৬ দফা দাবি তুলে ধরেন হাওরবাসী।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:
-
ইঞ্জিনচালিত নৌযান নিয়ন্ত্রণ
-
প্লাস্টিকবর্জ্য নিষিদ্ধ
-
পর্যটন শৃঙ্খলায় আনা
-
স্থানীয়দের নিয়োজিত করে ট্যুর গাইড প্রশিক্ষণ
-
রাতযাপন নিষিদ্ধ
-
হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিশেষ প্রকল্প ঘোষণা
টাঙ্গুয়ার হাওর, বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট, প্রাকৃতিক সম্পদের এক অতুলনীয় ভাণ্ডার।
১২,৬৫৫ হেক্টরের বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে ছড়িয়ে আছে ১০৯টি বিল, যার মধ্যে ৫৪টি প্রধান বিল।
বর্ষাকালে এসব বিল একাকার হয়ে বিশাল জলরাশিতে পরিণত হয়। তখন পুরো হাওর যেন এক সাগরের রূপ নেয়।
এই হাওরে বাস করে অসংখ্য দেশি-বিদেশি পাখি, মাছ ও জলজ প্রাণী। ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩৮টি ঝরনা এসে মিশেছে এই হাওরে, যা এর জীববৈচিত্র্যকে আরও সমৃদ্ধ করে।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অপরিকল্পিত পর্যটন, নির্দেশনা না মানা, বর্জ্য ফেলা, উচ্চ শব্দদূষণ—এসব কারণে হাওরের প্রাকৃতিক রূপ আজ মরণসংকটে।
পাখি কমে যাচ্ছে, মাছের প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে, বনজ সম্পদ ধ্বংসের মুখে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের স্পষ্ট বার্তা — পর্যটন চলবে, তবে তা পরিবেশবান্ধব উপায়ে।
নতুন করে জারি করা নির্দেশনা ভঙ্গ করলে জরিমানা ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পর্যটকদেরকে শুধু উপভোগ করতেই নয়, হাওরের রক্ষা-কর্তা হিসেবেও দায়িত্ববান হতে হবে।
টাঙ্গুয়ার হাওর কেবল একটি পর্যটনকেন্দ্র নয় — এটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।
এই হাওরকে রক্ষা করা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব।
সরকার, স্থানীয় মানুষ ও পর্যটক—সবার সচেতন অংশগ্রহণেই টাঙ্গুয়ার হাওর বাঁচবে, থাকবে প্রাণভরে।