সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার সোনারাম গ্রামে সম্প্রতি এমন একটি রহস্যময় "আয়নাঘর" এর সন্ধান পাওয়া গেছে, যা এলাকাজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। এখানেই পাঁচ মাস ধরে অন্ধকার ও আতঙ্কের মাঝে বন্দি ছিলেন ৭৫ বছর বয়সী আব্দুল জুব্বার ও ৪৮ বছর বয়সী নারী শিল্পী বেগম। অবশেষে বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে তারা সুড়ঙ্গ কেটে পালিয়ে আসেন। তাদের বর্ণনায় উঠে আসে লোমহর্ষক সব তথ্য—অপহরণ, চাঁদা আদায়, জমি লিখে নেওয়া, এমনকি কিডনি পাচারের মতো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডও!
ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্থানীয় জনগণের দাবি, দীর্ঘদিন ধরেই এই "আয়নাঘর" এর ভেতরে ভয়ঙ্কর অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল একটি সংঘবদ্ধ চক্র। তারা সাধারণ মানুষকে অপহরণ করে টর্চার করত এবং পরিবারকে ভয় দেখিয়ে সম্পত্তি লিখে নেওয়ার জন্য চাপ দিত। কেউ কেউ বলেন, এই ঘরটি বাইরে থেকে সাধারণ একটি রুম মনে হলেও ভেতরে রয়েছে বিভীষিকাময় ছোট ছোট কক্ষ, গোপন সুড়ঙ্গ এবং নজরদারির আয়নার পেছনে চাপা আতঙ্ক।
সুড়ঙ্গ কেটে ফিরে আসার রোমহর্ষক গল্প
উদ্ধার হওয়া শিল্পী বেগম জানান, “জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে আমাকে অপহরণ করা হয়। প্রথমে এক মাস অন্যত্র রাখা হয়, এরপর এই আয়নাঘরের ভিতরে পাঁচ মাস ধরে বন্দি রাখা হয়। মাঝে মাঝে শরীরে ইনজেকশন দেওয়া হতো। আমার সঙ্গেই ছিলেন বৃদ্ধ আব্দুল জুব্বার।”
তিনি আরও জানান, পল্লী চিকিৎসক পরিচয়ে থাকা নাজমুল হোসেন আরাফাত ও তার সঙ্গে থাকা আরও কয়েকজন মিলে এই বন্দিদশা চালাত। তাদের ভাষ্যমতে, রাতের আঁধারে এই চক্রটি নিয়মিতই ভবনে আসত এবং অমানবিক নির্যাতন চালাত।
নিখোঁজ ছিলেন ৫ মাস, বাড়ি ফিরেই হাসপাতালে ভর্তি
৭৫ বছর বয়সী আব্দুল জুব্বার গত বছরের ৮ নভেম্বর নিখোঁজ হন। খোঁজ না পেয়ে তার ছেলে শফিকুল ইসলাম ১২ নভেম্বর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে তিনি আচমকা বাড়ি ফিরে আসেন। স্বজনরা বলেন, তিনি তখন এতটাই দুর্বল ও অসুস্থ ছিলেন যে কথা বলতেও পারছিলেন না। পরদিন সকালে তাকে রায়গঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।
ঘটনাস্থলে পুলিশ, সাংবাদিক সেজে অপরাধ!
ঘটনার মূল অভিযুক্ত নাজমুল হোসেন আরাফাত একজন স্বঘোষিত পল্লী চিকিৎসক। একইসঙ্গে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় চলাফেরা করতেন। কিন্তু আয়নাঘরের ভেতরে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পর রায়গঞ্জ প্রেস ক্লাব থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
ওসি মো. আসাদুজ্জামান জানান, “ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে পুলিশ ইতোমধ্যে অভিযুক্ত আরাফাতকে আটক করেছে। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। ভুক্তভোগীরা আগে থেকেই থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেছিলেন।”
পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন বলেন, “ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল। আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি এবং আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
বিক্ষোভ ও ভাঙচুর, উত্তাল এলাকাবাসী
ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়। শুক্রবার সকাল থেকে শত শত উৎসুক মানুষ আয়নাঘর দেখতে ভিড় করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ জনতা অভিযুক্ত আরাফাত ও ভবনের মালিক সুমনের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
রহস্যময় আয়নার ঘরে কী চলত এতদিন?
স্থানীয়রা জানান, ভবনটি সোনারাম গ্রামের সুমনের মালিকানাধীন। অভিযুক্ত আরাফাত তার কাছ থেকে ভবনের নিচতলার অংশ ভাড়া নিয়ে সেখানে ৩-৪টি ছোট কক্ষ তৈরি করেন। কক্ষগুলোতে আয়না বসানো থাকলেও সেই আয়নার পেছনে ছিল সুড়ঙ্গ ও গোপন কক্ষ। গভীর রাতে এই আয়নাঘর হয়ে উঠত ভয়ংকর অপারেশন রুম!
শেষ কথা
এই আয়নাঘরের কাহিনি কেবল সিরাজগঞ্জ নয়, গোটা দেশবাসীকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। একদিকে সাংবাদিকের ছদ্মাবরণে মানবপাচারকারী চক্র, অন্যদিকে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা। প্রশ্ন উঠছে, এমন ভয়াবহ ঘটনা এতদিন ধরে কীভাবে চাপা পড়ে ছিল? প্রশাসনের কড়া তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা এবং সচেতন মহল।