সিলেটে পাথর লুট: জড়িত বিএনপি, আ.লীগ, জামায়াত ও সমন্বয়কদের সিন্ডিকেট..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
In Sylhet’s Shah Arefin Hill, stones worth hundreds of crores were looted within a year. Investigations reveal a powerful syndicate involving BNP, Awami League, Jamaat, and coordinators, while authori..

সিলেটের শাহ আরেফিন টিলায় মাত্র এক বছরে শতকোটি টাকার পাথর লুট হয়ে গেছে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও সমন্বয়কদের সমন্বিত সিন্ডিকেটের নাম। প্রশাসনের নীরব ভূমিকা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন।

সিলেটের শাহ আরেফিন টিলা, এক সময় ৫০ ফুট উঁচু সবুজ পাহাড় আর ৭০০ বছরের ঐতিহাসিক মাজারের জন্য বিখ্যাত ছিল। অথচ আজ সেটি যেন এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রায় ১৩৭ একর জায়গাজুড়ে থাকা এই টিলা এখন কেবল গর্ত আর ধ্বংসের নিদর্শন। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, গত এক বছরে দেদারছে পাথর লুটপাটের কারণে টিলার অস্তিত্বই শেষ হয়ে গেছে।

১৯৯৫ সালে পাথর উত্তোলন নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন করা হলেও, ১৯৯৯ সালে সরকারিভাবে ইজারা দিয়ে শুরু হয় টিলা কাটার প্রক্রিয়া। মাঝে মামলার কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে আবারো অবৈধভাবে শুরু হয় পাথর উত্তোলন। এক বছরের মাথায় টিলা সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে শতকোটি টাকার পাথর লোপাট হয়েছে।

যমুনা টেলিভিশনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য—এই ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে রয়েছে অন্তত ২০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির সমন্বয়ে গড়া একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। শুধু বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগ, জামায়াত এবং স্থানীয় সমন্বয়করাও এতে জড়িত। রাজনৈতিক বিভাজন ভুলে তারা একসঙ্গে লুট করেছে পাথর।

৫ আগস্টের পর অবৈধ পাথর বাণিজ্যের অন্যতম হোতা হিসেবে উঠে আসে উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক বাবুল আহমদ বাবুলের নাম। এছাড়া বিএনপি, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের স্থানীয় নেতাদের একের পর এক নাম সামনে এসেছে। বাবুল চেয়ারম্যান নামে পরিচিত এই নেতা অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে প্রমাণ বলছে, স্থানীয় জামায়াত কর্মী ইয়াকুব আলী পাথর পরিবহনের কাজ করতেন এবং ঘনফুটপ্রতি এক-দুই টাকা লাভ করতেন।

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের যেসব নেতা অতীতে পাথর লুটে সক্রিয় ছিলেন তারা বর্তমানে পলাতক। কিন্তু এলাকায় তাদের দাপট ও ভূমিকা নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনের চোখের সামনেই এসব কার্যক্রম চলেছে, এমনকি পুলিশের বিরুদ্ধেও ট্রাক ও ট্রাক্টর থেকে চাঁদা আদায়ের প্রমাণ মিলেছে।

ধলাই নদীর দুই পাড়ে শত শত জায়গায় লুটের পাথর জমা রাখা হতো। প্রতিটি জায়গার ভাড়া দিনে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল। শ্রমিকরা নৌকায় পাথর তুললেও প্রকৃত মুনাফা গেছে সিন্ডিকেটের হাতে। এক একটি নৌকা থেকে শ্রমিকরা পেত মাত্র চারভাগের একভাগ দাম, বাকি অংশ সিন্ডিকেটের ভাগে যেত। হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন অন্তত সোয়া কোটি টাকা করে লুট হয়েছে।

এই লুটপাটে উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সাহাব উদ্দিন শীর্ষস্থানীয় লাভবানদের একজন ছিলেন। যদিও তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন লুট ঠেকাতে তিনি আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু তার বাড়ি ও আশপাশে পাওয়া পাথরের স্তুপ বলছে অন্য কথা।

অভিযোগের তালিকায় উঠে এসেছে আরও অন্তত ৫১ জনের নাম, যারা প্রত্যক্ষভাবে এ অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। জেলা যুবদল, উপজেলা যুবলীগ, বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের নেতাকর্মী ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্র সংগঠনের নেতাদের নামও সামনে এসেছে।

এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামেও কেউ কেউ বৈধ পাথর উত্তোলনের দাবিতে মাঠে থাকলেও, বাস্তবে তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে পরিবেশবাদীরা বারবার প্রশাসনকে সতর্ক করলেও তাদের দাবি আমলে নেয়া হয়নি। বেলা’র বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আক্তার অভিযোগ করেছেন, “যারা অবৈধ পাথর উত্তোলন করছে, তাদের চেহারা বদলেছে, কিন্তু অপরাধ বন্ধ হয়নি। প্রশাসন চোখের সামনে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সব দেখেছে, অথচ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।”

অভিযোগের তীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দিকেও উঠেছে। কারণ, জুলাই মাসের ফুটেজে দেখা গেছে, তিনি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় নদী থেকে প্রকাশ্যে পাথর তোলা হচ্ছে। অথচ তাকেই এখন তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

এক বছরের এই লুটপাটে সাদাপাথর, জাফলং, আরেফিন টিলা এবং রাংপানি এলাকা থেকে প্রায় ৩ কোটি ঘনফুট পাথর উধাও হয়েছে। উদ্ধার করা গেছে মাত্র ৫ লাখ ঘনফুট। বাকিগুলো হয় বিক্রি হয়ে গেছে, নয়তো চূর্ণ হয়ে গেছে—যা আর কখনো ফেরত পাওয়া যাবে না।

এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে—প্রশাসন এতদিন চুপ ছিল কেন? সিন্ডিকেটের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল থাকায় কি তারা নিশ্চুপ ছিল? আর এই লুটপাটের আসল হোতারা কি আদৌ বিচারের মুখোমুখি হবে?

コメントがありません