close

লাইক দিন পয়েন্ট জিতুন!

শরণার্থী দিবসে রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে হৃদয়বিদারক আত্মপ্রকাশ!..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস। কিন্তু এইবার শরণার্থীদের কথা বলতে গিয়েই উঠে এসেছে বাংলাদেশের বহু নাগরিকের নিজস্ব উদ্বাস্তু হওয়ার বাস্তব চিত্র। রোহিঙ্গা সংকট থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্..

২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস। এই বিশেষ দিনে বাংলাদেশে আয়োজিত একটি আলোচনা সভা আমাদের মনে করিয়ে দেয় কেবল সীমান্ত পেরিয়ে আসা মানুষরাই নয়, আমরা নিজেরাও কখনো কখনো নিজেদের দেশেই শরণার্থী হয়ে উঠি—বাস্তুচ্যুত, অধিকারহীন, পরিচয়হীন।

১৯ জুন কক্সবাজার শহরে কোস্ট ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে জানা গেলো, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যা শুধু তাদের ক্যাম্পে আটকে নেই। আলোচনা সভার শিরোনাম ছিল, “বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দান: ভবিষ্যৎ ও চ্যালেঞ্জ।” এই এক সভাতেই যেন পুরো দক্ষিণাঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার ছবি ফুটে উঠেছে।

রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনিশ্চয়তা, অনুদান হ্রাসে ক্যাম্প পরিচালনায় ধস, শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হওয়া, স্থানীয় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের চাকরি হারানো, এমনকি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয়দের সশস্ত্র দ্বন্দ্ব—সবই উঠে এসেছে আলোচনায়। কিন্তু সমাধান? সে বিষয়ে কোনো রূপরেখা ছিল না। জেলা প্রশাসনের অনুপস্থিতিতে এসব সমস্যা আরও প্রকট।

টেকনাফ ও উখিয়ার জনপ্রতিনিধিরা আলোচনায় বলেছেন, রোহিঙ্গাদের অবাধ শ্রমবাজারে প্রবেশ ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমে জড়ানোর কারণে স্থানীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী জীবিকা হারিয়ে দিশেহারা। কৃষিকাজে ব্যবহৃত জমিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আগত বর্জ্যের কারণে পরিবেশ দূষণও মারাত্মক রূপ নিয়েছে। নাফ নদীতে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় জেলেরা হতাশায় দিন কাটাচ্ছে।

আলোচনায় আরও জানা যায়, সীমান্তে ইয়াবা চোরাচালান রোধে সীমান্তরক্ষীদের ব্যর্থতা, ক্যাম্পে অপরাধ প্রবণতা, রোহিঙ্গাদের মধ্যে দলাদলি এবং স্থানীয়দের জিম্মি করার মতো ঘটনা বেড়েই চলছে। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, নিবন্ধিত রোহিঙ্গারা কীভাবে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে অবাধে বিচরণ করছে—তা প্রশাসনের কেউই ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না।

আরও ভয়াবহ তথ্য এসেছে সাংবাদিকদের কাছ থেকে—রোহিঙ্গা নারীদের কক্সবাজার পর্যটন এলাকায় ব্যবহার করে চলা দেহব্যবসার চিত্র। সবমিলিয়ে এক ভয়ংকর সামাজিক সংকটের মুখোমুখি আমরা।

এই শরণার্থী সংকটের আলোচনার মধ্যেই একজন লেখক-অংশগ্রহণকারীর অনুভব উঠে এসেছে: “আজ যখন আমি রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু অবস্থার কথা ভাবছি, তখনই উপলব্ধি করছি—আমাদের দেশেই অনেকে আজ উদ্বাস্তু হয়ে আছে, কেউ দেশের ভিতরে, কেউ বাইরে।”

২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে বহু মানুষ রাজনৈতিক কারণে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে। কেউ স্বজনদের ছেড়ে বিদেশে, কেউ দেশের ভিতরেই পরিচয়হীনভাবে বাঁচছে। যারা একসময় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল, তারাই আজ হয়তো আশ্রয় প্রার্থনায় উদ্বিগ্ন। উদ্বাস্তু হওয়ার যন্ত্রণা কেবল রাজনৈতিক নয়—এটা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানসিক এক বেদনার নাম।

লেখক মনে করিয়ে দিয়েছেন—১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ—সবই ছিল রাষ্ট্রে ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার লড়াই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শাসকগোষ্ঠীর একচেটিয়া ক্ষমতা চর্চা, বিরোধীদের বঞ্চিত করার চর্চাই জন্ম দিয়েছে বৈষম্য ও অবশেষে ফ্যাসিবাদ।

১৯৯১ থেকে ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান পর্যন্ত সময়জুড়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সমমর্যাদার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সেবা পায়নি। রাজনৈতিক বিভাজন, আদর্শিক কর্তৃত্ব আর ভিন্নমতের দমন—সব মিলে রাষ্ট্রজুড়ে তৈরি হয়েছে এক ভয়ংকর অচলাবস্থা।

লেখক এক গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন—শুধু যারা রাষ্ট্র ছাড়তে বাধ্য হয়েছে তারাই শরণার্থী নয়। যারা নদীভাঙনে বাস্তুচ্যুত, যারা দারিদ্র্য কিংবা জলবায়ু সংকটে গ্রামের ভিটেমাটি ছেড়ে শহরের ফুটপাতে এসেছে, তারাও তো বাস্তুচ্যুত। অথচ রাষ্ট্র তাদের কোনো আইনি স্বীকৃতি দেয় না, কোনো সেবাও না। এমন বাস্তবতায় বিশ্ব শরণার্থী দিবসের তাৎপর্য বদলে যায়।

২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তন রাষ্ট্র পুনর্গঠনের নতুন সুযোগ এনেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা কি সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করব? আবারো কি কাউকে দুর্বল ভেবে বঞ্চিত করব? না কি বৈচিত্র্যকে সম্মান দিয়ে, সকল নাগরিককে সমান মর্যাদায় রাষ্ট্র গড়ব?

একজন রাজনৈতিক চিন্তাবিদের মতো করে লেখক সতর্ক করেন—যে রাষ্ট্র ভিন্নমতকে দমন করে, ভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে হুমকি মনে করে, সেই রাষ্ট্রেই একদিন সবাই উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। সুতরাং গণতন্ত্র মানে ভিন্নতাকে সম্মান করে একসঙ্গে বাঁচা।

বিশ্ব শরণার্থী দিবসে যদি আমরা কেবল রোহিঙ্গাদের দেখি, তবে অর্ধেক সত্য বুঝি। আজ আমাদের চারপাশেই অনেকেই বাস্তুচ্যুত, আশ্রয়হীন, পরিচয়হীন। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি আমাদের সমাজের ভেতরের উদ্বাস্তুদেরও দেখতে হবে। কারণ রাষ্ট্র যখন তার সকল নাগরিককে সমানভাবে সেবা দিতে ব্যর্থ হয়—তখন শরণার্থীর পথ কেউ নিজে বেছে নেয় না, রাষ্ট্র বাধ্য করে।

Keine Kommentare gefunden