শিক্ষার্থীরা এখন শ্রেণিকক্ষের চেয়েও আন্দোলনে বেশি মনোযোগী..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন। শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুম ছেড়ে নেমেছেন রাজপথে—দাবি আদায়ে চলছে লাগাতার কর্মসূচি। রাজনৈতিক ইন্ধন ও প্রশাসনিক ব্যর্থতায় চরম অস্থিরতা সব পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।..

বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন আজ এক চরম অস্থিরতার মুখোমুখি। শ্রেণিকক্ষের পরিবর্তে রাজপথ এখন শিক্ষার্থীদের মুখ্য জায়গা হয়ে উঠেছে। আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজ, কলেজ থেকে স্কুল পর্যন্ত। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই শিক্ষার্থীদের একের পর এক দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার কারণে শিক্ষার্থীরা নিজেদের অধিকারের পক্ষে মুখ খুলতে পারতেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আবির্ভাবে সেই অবরুদ্ধ কণ্ঠ যেন হঠাৎই জেগে উঠেছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি, বিক্ষোভ মিছিল কিংবা অবরোধে অংশ নিচ্ছেন।

শুধু শিক্ষার্থীরাই নন, শিক্ষকরাও যুক্ত হচ্ছেন এই দাবির মিছিলে। তাদের যৌথ উদ্যোগে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধের কারণে শহরজুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট ও জনদুর্ভোগ। রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে এমন দৃশ্য—যেখানে পড়ার টেবিল ছেড়ে রাজপথে দাঁড়িয়ে আছেন শিক্ষার্থীরা, তাদের সঙ্গে ব্যানার হাতে শিক্ষকরা।

ছাত্ররাজনীতি ও প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার ইস্যু
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলা হলেও এ নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা তৈরি হয়নি। এমনকি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়েও রয়েছে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে মতানৈক্য। এই অনিশ্চয়তার সুযোগে কেউ কেউ জড়াচ্ছেন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষকদের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য মব তৈরি করে মারধর ও পদত্যাগে বাধ্য করার মতো ঘটনাও ঘটছে।

পরীক্ষা পেছানো, আবাসিক সুবিধা, বৃত্তি, বাজেট বরাদ্দ ও প্রশাসনিক দুর্নীতি এসব নানা দাবির সমন্বয়ে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই গড়ে উঠছে নতুন আন্দোলন।

বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে আন্দোলনের চিত্র
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একাধিক দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন—আবাসন বৃত্তি, দ্বিতীয় ক্যাম্পাস স্থাপন, বাজেট বৃদ্ধি। আন্দোলনের চাপে সরকার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়, ফলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও একই দাবি তুলতে শুরু করেছেন।

সরকারি তিতুমীর কলেজ ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ‘সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ প্রকল্প বাতিল ও স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি জানিয়ে রাজপথে অবস্থান নিয়েছেন। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও করেছেন কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের সাত দফা দাবির মধ্যে রয়েছে আবাসিক হল সংস্কার ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা।

প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের হামলার ঘটনায় উত্তাল হয়ে পড়ে পুরো ক্যাম্পাস। এক পর্যায়ে উপাচার্যকে সরিয়ে দিতে হয়। একই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালেতেও, যেখানে শিক্ষার্থী-শিক্ষক আন্দোলনের মুখে উপাচার্যসহ শীর্ষ তিন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে সরকার।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও কম উত্তাপ নেই। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ও প্রশাসনের অনেকেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে পদত্যাগ করেন। গাজীপুরের ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের দাবিতে ইউজিসি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন।

কারিগরি শিক্ষার্থীদের দাবিতে দেশজুড়ে কর্মসূচি
ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের নিয়োগ ও রিট বাতিলের দাবিতে দেশের বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা হাইকোর্ট চত্বর পর্যন্ত অবস্থান নিয়ে দাবি আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

শিক্ষা খাত নিয়ে বিশ্লেষকদের উদ্বেগ
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান এস এম এ ফায়েজ জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত বলেই মনে হচ্ছে। আন্দোলনের নামে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে দাবি আদায়ের চেষ্টাকে তিনি অগ্রহণযোগ্য বলেও উল্লেখ করেন।

সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সরকারের সময়সীমা সীমিত হলেও অধিকাংশ সময়ই চলে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সামাল দিতে। অনেক দাবিতে অর্থের বিষয় জড়িত থাকায় তা মুহূর্তে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কিন্তু কিছু দাবির সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব জড়িয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদ মনে করেন, দীর্ঘদিন শিক্ষার্থীদের দাবি উপেক্ষিত থাকার কারণে তারা রাজপথে নেমেছেন। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া, লেখাপড়ায় অনিয়ম, ও প্রশাসনিক দুর্নীতিই এই অস্থিরতার প্রধান কারণ।

মানবিকতা ও সমাধানের আহ্বান
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীরা যদি আন্দোলনের মাধ্যমে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেন, তাহলে সাধারণ মানুষের সমর্থন হারিয়ে ফেলবেন। যৌক্তিক দাবিগুলো বিকল্প পদ্ধতিতে উপস্থাপন করলেই তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে।

সার্বিকভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ গভীর সংকটে। শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন, শিক্ষকরা হতাশ। একদিকে দাবি আদায়ের আন্দোলন, অন্যদিকে প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক ইন্ধনে ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে শিক্ষাঙ্গন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ, দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং দ্রুত কার্যকর সিদ্ধান্ত।

Không có bình luận nào được tìm thấy


News Card Generator