close

ভিডিও আপলোড করুন পয়েন্ট জিতুন!

রপ্তানি, প্রবাসী আয় ও রিজার্ভে স্বস্তি সত্ত্বেও গরিব বাড়বে?..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ তিন ক্ষেত্রেই সুখবর, অথচ বিশ্বব্যাংক বলছে বাংলাদেশে দারিদ্র্য বেড়ে যাবে। প্রবৃদ্ধিও কমবে। কী কারণে অর্থনীতির এমন উল্টো স্রোত? জানুন ভিতরের গভীর সংকটের চিত্র এই রিপোর্..

রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ বাড়ছে—তবু কেন বাড়ছে গরিবের সংখ্যা?

বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে একদিকে যখন রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির মতো সুখবর, অন্যদিকে তখন বিশ্বব্যাংক সতর্কবার্তা দিচ্ছে—দেশে গরিবের সংখ্যা বাড়বে, প্রবৃদ্ধি কমবে। এই দুই বিপরীতমুখী বাস্তবতার কারণ কী? কোথায় আটকে আছে অর্থনীতির চাকা?

বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি জানিয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে আরও ৩০ লাখ মানুষ ‘অতি গরিব’-এর তালিকায় যুক্ত হবে। বর্তমানে অতি দারিদ্র্যের হার ৭.৭ শতাংশ হলেও, তা বেড়ে হবে ৯.৩ শতাংশ। একইভাবে জাতীয় দারিদ্র্য হারও বাড়বে—২০.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২.৯ শতাংশে পৌঁছাবে।

২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। সেই হিসেবে, ২০২৫ সালের শেষে অতি গরিব মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ১ কোটি ৫৮ লাখে, আর মোট দরিদ্র জনগোষ্ঠী হবে প্রায় ৩ কোটি ৯০ লাখ।

প্রবৃদ্ধির বড় ধাক্কা: আয় কমছে, কর্মসংস্থান নেই

বিশ্বব্যাংক বলছে, মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, শ্রমবাজারের দুর্বলতা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক শ্লথগতিই এই অবনতির মূল কারণ। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নেমে আসতে পারে মাত্র ৩.৩ শতাংশে। জানুয়ারিতে এই হার ৪.১ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক আরও আশঙ্কা করেছে, গড় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশেপাশে থাকতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার বলেছেন, এখনই বাণিজ্য উন্মুক্তকরণ, কৃষি খাতে আধুনিকায়ন এবং বেসরকারি খাতে গতি আনাসহ অর্থনৈতিক সংস্কারে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

সাফল্যের খতিয়ান: রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে রেকর্ড

তবে সুখবরও কম নেই। ২০২৫ সালের মার্চে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৪.২৫ বিলিয়ন ডলারে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১.৪৪ শতাংশ বেশি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ মেয়াদে মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ৩৭.১৯ বিলিয়ন ডলার—গত বছরের তুলনায় ১০.৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি।

বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত থেকে আয় হয়েছে ৩০.২৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১০.৮৪ শতাংশ বেশি।

একইভাবে প্রবাসী আয়েও এসেছে বড় সাফল্য। মার্চ মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে ৩.২৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের মার্চের তুলনায় ৬৪ শতাংশ বেশি। একই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে হয়েছে ২৬.৩৯ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবেও রিজার্ভ বেড়ে ২১.১১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

তাহলে কেন সংকট?

এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘‘রপ্তানি, রেমিট্যান্স, রিজার্ভ বাড়লেও দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ছে না। উৎপাদন না বাড়ার মানে বিনিয়োগ বাড়ছে না। বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থানও তৈরি হয় না। ফলে আয়ের সুযোগ সংকুচিত হয়।’’

তিনি আরও যোগ করেন, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমছে, ফলে চাহিদাও কমছে। এর ফলে বিনিয়োগে অনীহা বাড়ছে। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, এবং বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়া এই সংকটকে আরও গভীর করছে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ছয় বছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এফডিআই কমে ১০৪.৩৩ মিলিয়ন ডলারে নেমেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ কম।

আমদানিও কমেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১.৬৫ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হলেও, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ১.১৫ বিলিয়ন ডলার। এর পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে গেছে, বাড়ছে সরকারি ঋণ নেওয়ার প্রবণতা।

সরকার চলতি অর্থবছরে ইতিমধ্যে ব্যাংক থেকে প্রায় ৩৮ হাজার ৫১০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির বলেন, ‘‘রেমিট্যান্সের টাকা ভোগব্যয়ে চলে যায়, বিনিয়োগে আসে না। রিজার্ভের অর্থও আমদানি ব্যয়ে ব্যবহৃত হয়। শেয়ারবাজারও দুর্বল। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান হয় না, প্রবৃদ্ধিও বাড়ে না।’’

তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘‘ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরাতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত না করতে পারলে অর্থনীতি আরও সংকটের মুখে পড়বে।’’

সামনে কী অপেক্ষা করছে?

বিশ্ব অর্থনীতিতেও অনিশ্চয়তা বাড়ছে। অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলছেন, ‘‘তিন মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য শুল্ক নীতির পরিবর্তন বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারেও প্রভাব ফেলতে পারে।’’

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানো, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং কর্মসংস্থান তৈরি করে জনগণের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি করা। নইলে রপ্তানি-রেমিট্যান্স-রিজার্ভের সাফল্যের মাঝেও দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক মন্দা বাংলাদেশের বাস্তবতা হয়ে উঠতে পারে।

Nenhum comentário encontrado