close

লাইক দিন পয়েন্ট জিতুন!

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি: বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তাদের মদদদাতাদের জবাবদিহির সংকট..

Bokhtiar Shamim avatar   
Bokhtiar Shamim
রাষ্ট্রের শক্তি তখনই বৈধতা পায়, যখন তা জনগণের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। রাষ্ট্রযন্ত্র যদি জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তবে তার সমস্ত অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশ, রাজনৈতিক ক্ষমতা..

শিরোনাম: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি: বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তাদের মদদদাতাদের জবাবদিহির সংকট

গত দুই দশকে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম ঘিরে একটি স্পষ্ট জন-আশঙ্কা গড়ে উঠেছে—যেখানে নিরাপত্তা বাহিনী নিজেই একাধিক অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, জমি দখল, মিথ্যা মামলা ও আর্থিক নিপীড়নের মতো কর্মকাণ্ডে। এই বাস্তবতায়, রাষ্ট্রশক্তির ব্যবহারের নৈতিকতা এবং নাগরিক অধিকারের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এই গবেষণামূলক প্রবন্ধে পুলিশ বাহিনীর অতিরিক্ত ক্ষমতা, রাজনৈতিক মদদ, হলুদ সাংবাদিকতার ভূমিকা এবং শাসকগোষ্ঠী দ্বারা ব্যবস্থার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা আলোচিত হয়েছে।

 

১. ভূমিকা

রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু যখন সেই রাষ্ট্রযন্ত্রই সাধারণ মানুষের জীবনে আতঙ্কের উৎস হয়ে দাঁড়ায়, তখন রাষ্ট্রের আইনি কাঠামো, নৈতিক বৈধতা এবং শাসনব্যবস্থার উদ্দেশ্য পুনর্বিবেচনা করা জরুরি হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে পুলিশ বাহিনীর একাংশের বিরুদ্ধে গুম, খুন, দখল ও নির্যাতনের মতো অভিযোগ প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পেয়েছে। এর পাশাপাশি, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিভিন্ন অংশে থাকা মদদদাতা ও সুবিধাভোগীরা এসব কর্মকাণ্ডে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছে—যা বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে আরও গভীর করেছে।

 

২. পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার ও নাগরিক অধিকার

পুলিশের কিছু সদস্যদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে—তারা রাজনৈতিক নির্দেশে বিরোধী মত দমন, অবৈধ অর্থ আদায়, জোরপূর্বক জমি দখল, ও মিথ্যা মামলার মাধ্যমে নিরীহ নাগরিককে হয়রানি করছে। মানবাধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন এ ধরণের কর্মকাণ্ডের তথ্য নথিভুক্ত করেছে। রাষ্ট্র যখন এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে না, তখন সেটি বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখে।

 

তথ্যসূত্র:

Human Rights Watch (2022). "No One is Safe: Abductions by Bangladesh’s Security Forces".

Amnesty International (2023). "Bangladesh: Human Rights in Peril".

Ain o Salish Kendra (ASK) Annual Reports, 2010–2024.

 

৩. মদদদাতা ও নেপথ্য পরিকল্পনাকারীদের দায়

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপকর্ম সাধারণত এককভাবে সংঘটিত হয় না। এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং প্রভাবশালী মহলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্দেশনা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুলিশ যেসব অপরাধে জড়িত, সেগুলোর নির্দেশনা এসেছে উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বা প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ মহল থেকে। এ প্রেক্ষাপটে, শুধুমাত্র বাহিনীর সদস্যদের দায়ী করলেই চলবে না—বরং যারা তাদের দিয়ে এসব কাজ করিয়েছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।

 

তথ্যসূত্র:

Transparency International Bangladesh (TIB). (2021). "Corruption in Law Enforcement Agencies".

Dhaka Tribune Investigative Reports (2022–2024).

 

৪. হলুদ সাংবাদিকতা ও জনমত প্রভাবিত করার কৌশল

গণমাধ্যম একটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত হলেও, বাংলাদেশে কিছু তথাকথিত সাংবাদিক জনস্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে অপরাধ ঢাকার কাজে জড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে হলুদ সাংবাদিকতার একটি অংশ পুলিশ ও ক্ষমতাসীন মহলের পক্ষে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে জনমতকে বিভ্রান্ত করছে এবং অপরাধীদের রক্ষা করছে। এই প্রবণতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।

তথ্যসূত্র:

Reporters Without Borders (RSF). World Press Freedom Index, 2023.

Media Watch Bangladesh. (2023). "Yellow Journalism and State Complicity".

 

৫. সুবিধাভোগী শ্রেণি ও কাঠামোগত দুর্নীতি

প্রশাসন, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, ঠিকাদার এবং স্থানীয় রাজনৈতিক চক্রের একটি অংশ পুলিশি অপরাধের সঙ্গে জড়িত থেকে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করছে। তারা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার আশায় রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে ব্যবহার করছে এবং এসব অপরাধকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধেও জবাবদিহিমূলক তদন্ত অপরিহার্য।

 

তথ্যসূত্র:

Bangladesh Economic Review (2023). Ministry of Finance, GoB.

TIB Thematic Reports on Institutional Corruption (2020–2024).

 

৬. সুপারিশ

এই পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য নিচের সুপারিশগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:

একটি স্বাধীন, স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠন করে পুলিশি ও প্রশাসনিক অপরাধের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত।

 

বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মদদদাতা ও নির্দেশদাতাদের বিচারের আওতায় আনা।

গণমাধ্যমে নৈতিকতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা এবং হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।

নাগরিক সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি জনপর্যবেক্ষণ প্ল্যাটফর্ম তৈরি, যা রাষ্ট্রীয় অপরাধ নজরদারি করবে।

সংশ্লিষ্ট সকল অপরাধের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান, যা ভবিষ্যতের জন্য সতর্কতা হিসেবে কাজ করবে।

 

৭. বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ

রাষ্ট্রের শক্তি তখনই বৈধতা পায়, যখন তা জনগণের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। রাষ্ট্রযন্ত্র যদি জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তবে তার সমস্ত অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশ, রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং মিডিয়া—এই তিনটি স্তরের অপব্যবহার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে রূপ নিচ্ছে। এই বাস্তবতায়, একটি শক্তিশালী, নিরপেক্ষ এবং দায়বদ্ধ ব্যবস্থা ছাড়া গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা অসম্ভব।

এই প্রবন্ধে উত্থাপিত প্রশ্ন ও প্রস্তাবনা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে, যেন বাংলাদেশ একটি দায়বদ্ধ ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে পুনরায় গড়ে উঠতে পারে।

Hiçbir yorum bulunamadı