রাজনীতির প্রতিশোধ অনেকটা প্রকৃতির প্রতিশোধের মতো—নিঃশব্দ হলেও নির্মম ও কঠিন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জনপ্রিয় টকশো উপস্থাপক জিল্লুর রহমান সম্প্রতি তাঁর নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত বক্তব্যে এমন মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, রাজনীতিতে সততা, দূরদৃষ্টি ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে পতন অনিবার্য হয়। অনেক সময় রাজনীতিবিদরা ভাবেন তাঁদের ক্ষমতা অটুট থাকবে, কিন্তু ইতিহাস দেখায়—অসততা ও অহংকারের মূল্য শেষ পর্যন্ত চুকাতেই হয়।
জিল্লুর রহমান বলেন, “আজ শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান—এটি কি অত্যন্ত বিস্ময়কর নয়? যে ব্যবস্থাটি তিনি নিজেই সংবিধান থেকে বাতিল করেছিলেন, আজ তিনিই আবার সেটির দাবি করছেন।” তাঁর মতে, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন বিএনপি ও অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। অথচ আজ নিজেদের স্বার্থে তারাই প্রশ্ন তুলছে, ‘আওয়ামী লীগ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন কীভাবে সম্ভব?’ বিশ্লেষকের মতে, ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হচ্ছে—যারা এক সময় প্রতিপক্ষকে বঞ্চিত করেছে, আজ তারা নিজেরাই একই পরিস্থিতিতে পড়েছে।
বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ টেনে জিল্লুর রহমান বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আদালতকে ব্যবহার করে তারেক রহমানের বক্তব্য বন্ধ করা হয়েছিল। তখন আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম—কেন তাঁর বক্তব্য প্রচার হবে না? আজ আবার একইভাবে শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। ইতিহাস যেন নিজেদের তৈরি ফাঁদে তাঁদেরকেই ফেলছে।”
গণমাধ্যম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমের কাজ হচ্ছে তথ্য উপস্থাপন করা, জনগণকে সচেতন রাখা ও বিশ্লেষণ তুলে ধরা। তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়—এ বিষয়টিও গণমাধ্যমকে মাথায় রাখতে হবে। কিন্তু সরাসরি আদালত বা সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। তিনি মনে করেন, অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা না নিলে রাজনীতির ইতিহাস বারবার একইভাবে প্রতিশোধ নেবে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে জিল্লুর রহমান বলেন, দেশ এখন এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের উপর। আন্তর্জাতিক মহল যেমন একটি গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চায়, তেমনি দেশের জনগণও চায় এমন একটি ভোট যা সত্যিকার অর্থে তাদের মতামত প্রতিফলিত করবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে রয়েছেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তবে তাঁর সরকার স্থায়ী নয়। জনগণই ভোটের মাধ্যমে স্থায়ী সরকার নির্বাচিত করবে।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো নানা শর্ত দিচ্ছে। কেউ চাইছে জুলাই সনদ ছাড়া নির্বাচন হবে না, কেউ চাইছে পিআর পদ্ধতি, আবার কেউ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের দাবি তুলছে। কিন্তু নির্বাচন কোনো দলের শর্তে আটকে থাকার বিষয় নয়, বরং এটি জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। তাঁর মতে, এনসিপি ও জামায়াত চাইছে নির্বাচন দেরি হোক যাতে তারা ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে। কিন্তু এভাবে সংবিধানকে উপেক্ষা করে নিজেদের শর্ত চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে—জানিয়ে জিল্লুর রহমান বলেন, “সব দলের এখন উচিত বিভাজন ভুলে আলোচনায় বসা ও সমঝোতায় পৌঁছানো। বিভাজন নয়, দরকার ঐক্য। একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হতে হবে যেটি জনগণের কাছে উৎসবের মতো হবে এবং বিশ্ব সেটিকে সম্মান করবে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর আমাদের আর ভুল করার সুযোগ নেই।”
তিনি সতর্ক করে দেন, রাজনীতিতে যদি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনগণের আস্থা পুনর্নির্মাণ না করা যায়, তাহলে প্রকৃতির মতোই রাজনীতির প্রতিশোধ আসবে—নিঃশব্দ কিন্তু নির্মম।