প্রাথমিক শিক্ষা: পরতে পরতে বৈষম্য

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
প্রাথমিক শিক্ষার পরতে পরতে বৈষম্য। মাঠ পর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষক-কর্মকর্তারা হতাশা আর ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে। বৈষম্যের পাহাড় ডিঙিয়ে মিলছে না তাদের পদোন্নতি। সরক
প্রাথমিক শিক্ষার পরতে পরতে বৈষম্য। মাঠ পর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষক-কর্মকর্তারা হতাশা আর ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে। বৈষম্যের পাহাড় ডিঙিয়ে মিলছে না তাদের পদোন্নতি। সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) অধীনে পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসার (এইউইও/এটিও) পদে চাকরি পেলেও চাকরি জীবনে কোনো পদোন্নতি নেই, ভাবা যায়! প্রায় একই অবস্থা প্রাথমিক শিক্ষার অন্যান্য পদের ক্ষেত্রেও। বেতন স্কেলেও রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। প্রাথমিক শিক্ষার দক্ষ জনবল থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন ক্যাডার দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা করায় মিলছে না প্রাথমিক শিক্ষার কাঙ্খিত ফলাফল। প্রাথমিক শিক্ষায় আমলাতন্ত্রের ছত্রছায়ায় তৈরিকৃত নতুন কারিকুলাম গ্রহণ করেনি শিক্ষক অভিভাবক এমনকি প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা। শ্রেণিকক্ষে গিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে জিজ্ঞেস করা হলে তারা উত্তর দেয়, হ্যাঁ পরীক্ষা দিতে চায় তারা। পরীক্ষা ছাড়া তাদের ভালো লাগেনা, লেখাপড়ায় আগ্রহ আসে না। অন্য দেশের আদলে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বিগত সরকার এনসিটিবিকে দিয়ে যে কারিকুলাম তৈরি করেছে তা মাঠ পর্যায়ে চলছে না মোটেও। প্রকৃতপক্ষে এই কারিকুলাম গ্রহণযোগ্যতা পায়নি সর্বস্তরের স্টেক হোল্ডারদের কাছে। যে লক্ষ্য নিয়ে এই কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে আদতে তা মিলছে না। কোচিং ব্যবসা, প্রাইভেট টিউটর আর গাইড বই এর দৌরাত্ম বন্ধ হয়নি। অভিভাবকরা দিশেহারা কি হতে যাচ্ছে তাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ। এটাই বাস্তবতা। ধারাবাহিক মূল্যায়নের জন্য ডায়েরি ওয়ান, ডায়েরি টু বিষয়ে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের ট্রেনিং দিয়ে পরক্ষণে আবার বলা হচ্ছে যে, না ডায়েরি ওয়ান ডায়েরি টু চলবে না। শিক্ষকদেরকে অ্যাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়ন করতে হবে। একেক সময় একেক নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে গ্রামেগঞ্জে কাজ করা প্রাথমিক শিক্ষকদেরকে দিশেহারা করে তুলেছে। এমনিতেই প্রাথমিক শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা কম। প্রাথমিক শিক্ষকদের রয়েছে চূড়ান্ত রকমের বেতন বৈষম্য। একজন হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ষষ্ঠ গ্রেড পেলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মর্যাদার দিক দিয়ে এবং বেতন কাঠামোর দিক দিয়ে অনেক বৈষম্যের শিকার। অথচ এক একজন প্রাথমিক শিক্ষক প্রতিদিন ৭-৮ টি ক্লাস নিয়ে থাকেন। বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা কম তাদের। এমনকি এনসিটিবি থেকে বেঁধে দেওয়া হয় তাদের শ্রেণি রুটিন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাজের অন্তনেই। উপবৃত্তি থেকে শুরু করে তথ্য আদান-প্রদান করা, মিটিং, ওয়ার্কশপ, ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করা, পিটিএ মিটিং, এসএমসি মিটিং, বই বিতরণ, হোম ভিজিট, অনলাইনে ডাটাবেজ হালফিল, শিক্ষার্থীদের প্রোফাইল হালফিল, ভৌত অবকাঠামোগত মেরামত ও সংস্কার দেখাশোনা করা আরো আরো অনেক কাজ করতে হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে। এছাড়া বিভাগ বহির্ভূত কাজ তো আছেই। জাতীয় নির্বাচনের সময় এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সরকার আসে সরকার যায় অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন কাঠামো নিয়ে বৈষম্য থেকেই যায়। মাঠ পর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষার নিজস্ব কর্মকর্তারা হতাশায় চূড়ান্ত ভাবে নিমজ্জিত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে এই সমস্ত মিড লেভেলের অফিসারদেরকে দিয়ে নানা অন্যায় কাজ করিয়ে নেয়। বদলি বাণিজ্য, নিয়োগের সময় বাণিজ্য যেন ওপেন সিক্রেট। প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনেও নেই কোন শৃঙ্খলা। একশ্রেণির সুবিধাবাদী কর্মকর্তা বিগত প্রায় ১৬ বছর সুবিধা ভোগ করে লুটেপুটে প্রাথমিক শিক্ষার বেহাল দশা সৃষ্টি করেছে। বিগত বছরগুলোতে নৈরাজ্য আর হয়রানির কবলে পড়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ক্ষোভে ফুঁসছে। প্রাথমিক শিক্ষার কর্তা ব্যক্তিরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের থাকায় প্রাথমিক শিক্ষার নিজস্ব লোকেরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। এমনকি তারা তাদের প্রফেশনাল দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে অসুবিধা সম্মুখীন হলে সে কথা শোনারও লোক নেই। তাদের কণ্ঠ রোধ করে রাখা হয়। এক একজন মহাপরিচালক, পরিচালক স্বল্প সময়ের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে ডেপুটেশনে এসে বছরের পর বছর কাজ করে যাওয়া দক্ষ জনবলকে পুলিশি কায়দায় শাসন করে যায়। ট্রেনিং, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ বাবদ প্রাথমিক শিক্ষায় যে পরিমাণ টাকা ব্যয় করার নামে অপচয় করা হয় তা দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূর করা যায়। প্রাথমিক শিক্ষায় শুধু অপচয় আর অপচয়। মাঠ পর্যায়ের শিক্ষক কর্মকর্তা অভিভাবক সবাই বৈষম্যের শিকার। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা নিজেদের কথা বলতে পারে না। তাই তাদের অধিকার রক্ষার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার অন্যান্য স্টেক হোল্ডারদের কন্ঠ সোচ্চার করার সময় এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষায় এত বৈষম্য এত নৈরাজ্য এত দুর্নীতি বাংলাদেশের আর কোনো দপ্তরে আছে বলে মনে হচ্ছে না। ফোর প্লাস বয়স থেকে টেন প্লাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের ঠিকমতো গড়ে তুলতে না পারলে বৈষম্যহীন নাগরিক, বৈষম্যহীন সমাজ আর বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন কি করে পূরণ হবে? প্রাথমিক শিক্ষা সংস্কার হোক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম এবং প্রধান প্রায়োরিটি। কারণ শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ। শিশুরাই অধিকার রাখে প্রথম প্রায়োরিটি পাওয়ার। লেখক: সমন্বয়ক, প্রাথমিক শিক্ষায় বৈষম্য নিরসন পরিবার ও সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, গাজীপুর।
Inga kommentarer hittades


News Card Generator