পাকিস্তানের হাতে চীনের উন্নত হ্যাংগর-শ্রেণির সাবমেরিন চলে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার সামুদ্রিক নিরাপত্তায় নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। আধুনিক প্রযুক্তি ও ভয়ংকর অগ্নিশক্তিসম্পন্ন এই সাবমেরিন ভারত মহাসাগরে শক্তির ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পাকিস্তান-চীন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আবারও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। বৃহস্পতিবার চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে পাকিস্তান নৌবাহিনীর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেওয়া হয় তৃতীয় হ্যাংগর-শ্রেণির সাবমেরিন। আটটি সাবমেরিন সরবরাহের প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে এটি পাকিস্তানের জন্য এক বিশাল কৌশলগত সাফল্য। চলতি বছরের মার্চে দ্বিতীয় সাবমেরিন হস্তান্তরের পর এটি হলো সর্বশেষ সংযোজন।
পাকিস্তান নৌবাহিনী মনে করছে, এই উন্নতমানের সাবমেরিন শুধু তাদের সামুদ্রিক প্রতিরক্ষাকেই মজবুত করবে না, বরং ভারত মহাসাগরে শক্তির ভারসাম্য রক্ষায়ও কার্যকর ভূমিকা রাখবে। পাকিস্তানের ডেপুটি চিফ অব নেভাল স্টাফ ভাইস অ্যাডমিরাল আবদুল সামাদ এক বিবৃতিতে বলেন, “হ্যাংগর-শ্রেণির সাবমেরিনের অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সেন্সর আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে সহায়ক হবে এবং সামুদ্রিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।”
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস জানিয়েছে, এই সাবমেরিনের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী পানির নিচে যুদ্ধক্ষমতা, উন্নত সেন্সর সিস্টেম, উৎকৃষ্ট স্টেলথ প্রযুক্তি, উচ্চ গতিশীলতা, দীর্ঘ সময় পানির নিচে টিকে থাকার ক্ষমতা এবং ভয়ংকর অগ্নিশক্তি। ধারণা করা হচ্ছে, এতে এয়ার–ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রপালশন (এআইপি) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যা সাবমেরিনকে দীর্ঘ সময় পানির নিচে টিকে থাকতে সহায়তা করে। যদিও পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি নিশ্চিত করেনি, ভারতের হাতে এখনো এই প্রযুক্তি সম্পন্ন সাবমেরিন নেই।
ভারতের হাতে বর্তমানে দুটি পারমাণবিকচালিত সাবমেরিন থাকলেও এআইপি প্রযুক্তি সম্পন্ন সাবমেরিনের অভাব তাদের জন্য বড় দুর্বলতা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও) নিজস্ব এআইপি প্রযুক্তি তৈরি করেছে, যা ভবিষ্যতে কালভারি-শ্রেণির সাবমেরিনে স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
পাকিস্তানের নৌশক্তি বৃদ্ধির এ প্রক্রিয়ায় চীনের অবদান ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। এর আগে চীন পাকিস্তানকে চারটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজ সরবরাহ করেছে। পাশাপাশি বেলুচিস্তানের গওয়াদর বন্দর ও ভারত মহাসাগরে বেইজিংয়ের উপস্থিতি দ্রুত বাড়ছে, যা ভারতীয় কৌশলবিদদের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপ্রি) তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের মোট সামরিক সরঞ্জামের ৮১ শতাংশই আসে চীন থেকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে রিজওয়ান নামের প্রথম স্পাইশিপ, ৬০০–এর বেশি ভিটি-৪ ব্যাটল ট্যাঙ্ক, ৩৬টি জে-১০সিই যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করেছে। ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো জে-১০সিই পাকিস্তানের হাতে পৌঁছায়। এর আগে দুই দেশ যৌথভাবে তৈরি করেছিল জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান, যা ভারতবিরোধী সংঘাতে ব্যবহার করেছে পাকিস্তান।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের হাতে চীনের উন্নত সাবমেরিন পৌঁছানো নিঃসন্দেহে নয়াদিল্লির জন্য বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। বিশেষ করে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনা প্রযুক্তি নির্ভর পাকিস্তানি নৌবাহিনী শক্তিশালী হয়ে উঠলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক সমীকরণে পাকিস্তানের এ নতুন অর্জন যে ভারতের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি করেছে তা স্পষ্ট। আগামী দিনে ভারত মহাসাগরে শক্তির ভারসাম্য কোন দিকে গড়াবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।