মূল্যস্ফীতির ঘাত-প্রতিঘাত: চ্যালেঞ্জের পাহাড়ে হিমশিম খাচ্ছে সরকার

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে চাপে পিষ্ট সাধারণ মানুষ। টাকার অবমূল্যায়ন, রিজার্ভ সংকট, আমদানির সীমাবদ্ধতা, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং বাজারে অব্যবস্থাপনার কারণে
দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে চাপে পিষ্ট সাধারণ মানুষ। টাকার অবমূল্যায়ন, রিজার্ভ সংকট, আমদানির সীমাবদ্ধতা, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং বাজারে অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিনিয়ত ভোক্তারা ‘চিড়েচ্যাপ্টা’ হচ্ছেন। বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের জীবন যাপন আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। সরকার বলছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও সময় লাগবে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য হ্রাসের সুবিধা কাজে লাগিয়ে সরকার চাইলে দ্রুতই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মূল চ্যালেঞ্জ হলো দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে পরিস্থিতি ভিন্ন। বাজারে প্রতিযোগিতা না থাকা এবং কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপের দখলে ভোগ্যপণ্যের বাজারের কারণে সিন্ডিকেটের প্রভাব বেড়েছে। এ অবস্থায় সরকারকে বাজারে সুশৃঙ্খল প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশের প্রধান সমস্যা মূল্যস্ফীতি নয়, বরং দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। তিনি আরও বলেন, "বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও আমাদের বাজারে তার প্রভাব পড়েনি। সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনা দুর্বল, আর কিছু পণ্য সরবরাহ কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। বাজারে নতুন প্রতিযোগিতা তৈরি করলেই সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব।" দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চিত্র সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে টানা দুই বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের ওপরে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১.৩৮ শতাংশ। শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি, যা ১৪.৬৩ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাস্তব পরিস্থিতি সরকারি হিসাবের চেয়ে আরও ভয়াবহ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি জানিয়েছে, গত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার ১৫ থেকে ১৭ শতাংশের মধ্যে। চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির কড়াকড়ি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে শুল্ক ছাড়ের মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে নীতি সুদহার তিন দফা বাড়িয়েছে। তবুও বাজারে পণ্যের দাম কমেনি। অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব শিল্প উৎপাদনে নেতিবাচক হতে পারে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলে পণ্যমূল্য আরও বাড়তে পারে। সিন্ডিকেট ও বাজার মনিটরিং বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি। বাজার নিয়ন্ত্রণ করে হাতেগোনা কিছু শিল্প গ্রুপ। আগের সরকারের সময়কার দুর্নীতি ও ব্যাংক খাতের লুটপাট পরিস্থিতিকে আরও সংকটাপন্ন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ সংকটের কারণে ঋণের সুদহার বৃদ্ধি এবং মুদ্রা অবমূল্যায়নের ফলাফল হিসেবে আমদানির খরচও বেড়ে গেছে। চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো এম হেলাল আহম্মেদ জনি বলেন, "বাজারে চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট এবং দুর্নীতি দ্রুত বন্ধ করা না গেলে মূল্যস্ফীতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। পাশাপাশি সরকারকে দুর্বল ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।" সরকারের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মধ্যে আরও সমন্বয় প্রয়োজন। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর এবং বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে একযোগে কাজ করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং বাজার মনিটরিং জোরদার করলেই মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, "পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে এনবিআর কর ছাড় দিলেও বাজারে তার প্রভাব পড়ছে না। চাঁদাবাজি ও সরবরাহ ব্যবস্থায় অনিয়ম বন্ধ না হলে দাম কখনই নিয়ন্ত্রণে আসবে না।" দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং কার্যকর বাস্তবায়ন ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে। মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি এবং বাজার মনিটরিংয়ে যথাযথ সমন্বয় না ঘটলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে। সরকারের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং সিন্ডিকেট ভাঙা। "মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে সরকারকে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, নইলে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস আরও দীর্ঘায়িত হবে।"
No comments found


News Card Generator